রূপমাধুর্য ও বিপর্যয়ের সংগীত বর্ষা
বছরের ছয়টি ঋতুর মধ্যে একটি অন্যতম ঋতু হলো বর্ষা ঋতু। যার আগমন ঘটে গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপপ্রবাহের ঠিক পরেই। এই ঋতু যা একদিকে আনে নবজীবনের বার্তা, আবার, কখনো কখনো বয়ে আনে বিষাদের ঘন কালো মেঘ। আমাদের ছোটবেলায় যে বর্ষাকে দেখে বড় হয়েছি সেখানে জুড়ে আছে সৃষ্টিশীলতা, উৎসব এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ঘনঘটাময় একটি ঋতুর আবেশময় দিক, যা এই বর্ষার ঋতুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বর্ষার আগমন গ্রাম বাংলার বুকে এক নতুন জীবনের সূচনা করে। সবুজে আবৃত চারিপাশ, ঘন গাছপালা, আর সীমান্তহীন মাঠ গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে অবিরাম বৃষ্টি এক অপূর্ব দৃশ্যের সূচনা করে বৈকি। আকাশের গম্ভীর ঘন কালো মেঘ যেন ধান ক্ষেতের ওপরে নেমে এসে তাদের সাথে কোলাকুলিতে লিপ্ত হয়, বর্ষার আনন্দে লুটোপুটি খায় তারা, তাইতো কবি রবীন্দ্রনাথের ছন্দে মনে পড়ে,
" আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে
জানি নে জানি নে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না,
ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে।"
যেখানে চেনা গ্রাম্য মেঠো পথ জেগে ওঠে কাদামাটির গন্ধে মাখামাখি হয়ে, ছোট ছোট খাল বিল গুলো বর্ষায় ভরপুর হয়ে খিলখিলিয়ে ওঠে, সেখানে জড়িয়ে থাকে শিশুদের কোলাহল, কাগজের নৌকা ভাসানো হুটোপুটি করে, আনন্দে- হুল্লোড়ে পরিপূর্ণ এক সুন্দর মায়াঘেরা দৃশ্য। কখনও কান পেতে শুনতে পেয়েছ কি বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে মৃদু বাতাস, আর বৃষ্টির ছন্দ মিলে এক সুরেলা সঙ্গীতের মূর্ছনা?গ্রামের কাঁচা ঘরগুলোর চলে টাপুর টুপুর বৃষ্টির ছন্দ এক সুরেলা সঙ্গীতের সুর শোনায়। তখন কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছা করে,
"আবার আসিব আমি বাংলার নদী, মাঠ, ক্ষেত ভালবাসি বলে,
এখানে মানুষের গাছের ছায়ায় ঘুমাইবার স্বপ্নে"।
বৃষ্টির ফোঁটায় সিক্ত বিভিন্ন ধরনের পাখির ভেজা ডানা, ঝিঁঝিঁ পোকার কোরাস ডাক, মেঘের গর্জন, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ, গ্রাম্য পরিবেশ মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এই বৃষ্টিমুখর দিনে। বাংলার বর্ষা মানেই কিন্তু আবার নতুন নতুন উৎসবের সূচনা, নবান্ন উৎসব, হালখাতা, রাখি পূর্ণিমা, রাখালদের দই- মাখনের উৎসব সবকিছুই কিন্তু এই বর্ষাকে ঘিরেই। তাই এই বর্ষার আবাহনে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলা যায়,
" নতুন কুয়াশার জাল বিস্তার করে, বাংলার নদী মাঠঘাট,
আকাশ-বাতাসে মিশে যায়, কোন অজানায়, অচেনার রাত"।
বর্ষা ছোটবেলার স্মৃতিচারণ ও নানা আনন্দময় ঘটনার স্মৃতিকে উসকে দিয়ে তা আরোও আনন্দমধুর করে তোলে। বর্ষার জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানো, সেই জলে ছপছপ করে লাফিয়ে নিজেদেরকে ভিজিয়ে তোলা, কাদা মেখে ফুটবল খেলার স্মৃতি উসকে ওঠে এই বর্ষণমুখর দিনগুলোতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়,
"তুই ফোটাবি ফুল, আমি গেঁথে নেব মালা,
সেই মালায় তোর হাসির আভাজ্বলে উঠুক আকাশের তলা"।
বর্ষার মুখরিত দিনগুলি কবির কলম কে করে সৃষ্টিতে মগ্ন। কবির মনকে করে উদ্বেলিত। কবি তাঁর কবিতার সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন হয়ে ওঠেন এই বর্ষণমুখর দিনগুলিতে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "বর্ষার দিনে" কবিতার মতই বহু সৃষ্টি বর্ষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। শিল্পী, কবি, লেখকদের হৃদয়ে বর্ষার অনুভূতিকে উপলব্ধি করে তাদের সৃষ্টির স্মরণী বেয়ে কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে,
"এই পৃথিবীর সবুজ মেশানো অন্ধকারে,
আমার একা মন হাঁটিয়া চলে তোমারই স্মৃতির পথ বেয়ে"।
বর্ষা যেমন একদিকে হর্ষ, তেমনি বিষাদ ও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়,বন্যা, ভূমিধ্ব্বস, ঘূর্ণিঝড়, মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয় এক লহমায়। বর্ষার হর্ষময় দিনগুলি বিপর্যয়ের করুন চিত্র নেয়। সেখানে থাকে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, কত মানুষের গৃহহীনতা, জল বাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। কবি সুধীন্দ্র নাথ দত্তের কথায় বলতে ইচ্ছা করে
"আকাশের কোণে জড়ো মেঘ,
অবিরল ঝরে বৃষ্টি স্নিগ্ধ পথরেখা"।
বর্ষার ঘন মেঘ মনকে বিষন্নময় করে তোলে বৈকি কখনোও কখনোও। একাকিত্বের অনুভূতি, অতীতের স্মৃতিগুলোকে মনের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করে
"কেউ কথা রাখে না, কেউ কথা রাখে না,
তবু অভিমানে ছায়া রাত্রির পথ ধরে চলে যায়"।
প্রিয়জনদের হারানোর ব্যথা, বেদনা তীব্র থাকে এই বিষাদময় দিনগুলিতে। বৃষ্টির ছন্দে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা ফিরে আসে তাদের ভান্ডার সাজিয়ে। মন মেজাজের পরিবর্তন হয় মেঘলা দিনের বাদল মেঘের মতোই। অবিরাম বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনকে বড়ই ক্লান্ত ও বিষাদময় করে তোলে।
বর্ষার প্রথম ফোঁটা যেমন মাটির বুকে ও মানুষের মনে স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনিভাবেই সেই স্নিগ্ধতার পরশই একসময় রূপ নেয় এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে। গ্রাম থেকে শহুরে জীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। কৃষকদের কৃষি ঘিরে আশা নিরাশায় পর্যবসিত হয়। ধানের ক্ষেতে জল জমে নষ্ট হয় বহু ফসল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলে উঠতে ইচ্ছে করে,
"ঝড়ের কুৎসিত মূর্তি করে গর্জন,
আকাশের কোণে কোণে তপ্ত বজ্রের মতন"।
তবে বর্ষার হরষিত রূপ ও বিষাদময় রূপকে প্রত্যক্ষ করে বলা যায় এই সৃষ্টিশীল ঋতু বর্ষা, যা আমাদের জীবনকে তার রূপ, রং, সৌর্ন্দয্য দিয়ে এক তুলির টানে মনকে যেমন মোহিত করে, তেমনি বিপর্যয়ের পথ বিছিয়ে জীবনে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখিও করে। এই ঋতুর দ্বৈতস্বরূপ। বর্ষার অবিরাম বৃষ্টির শেষে আকাশও কখনও কখনও মোহময়ী হয়ে ওঠে রামধনুর রঙে, তখন কিন্তু মানুষের মন ও নেচে ওঠে নতুন করে শুরু করার এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। বর্ষার প্রতিটি ফোঁটা তখন নিয়ে আসে এক আনন্দঘন আমন্ত্রণ বার্তা। সেই সময়কালে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গেয়ে উঠতে মন চায়, "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি"।
বর্ষা ঋতু আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য্য ঋতু হিসেবে আজ সমাদৃত।