Logo
logo

সাহিত্য / কবিতা

স্বাধীনতার পথ চলা: প্রাপ্তি ও প্রতিবন্ধকতা

"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়,
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিতে পায় হে,
কে পরিতে পায়,
কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে, নরকের প্রায়!
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ সুখ তায় হে,
স্বর্গ সুখ তায়!"
---রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
কবির কবিতার মাধ্যমে বলতে পারি স্বাধীনতা শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক সুদূরপ্রসারী, স্বাধীনতা শুধুই কি রাষ্ট্রের? স্বাধীনতা জড়িয়ে থাকে আমাদের চিন্তায়, আমাদের মত- প্রকাশে, সর্বোপরি একজন ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতায় অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয় হচ্ছে এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচা যে বড় কঠিন, দাসত্বের শৃঙ্খলা- ময় সে জীবন, আমাদের জীবন যদি ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা বিহীন জীবন হয়, চিন্তার স্বাধীনতার অনুপস্থিতি থাকে, তবে কখনোই অন্তর্নিহিত সুকুমার বৃত্তিগুলোর জাগরণ ঘটে না, পরাধীনতার চিন্তার ফল কিন্তু কখনোই ফলপ্রসু হয় না।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নিজেদের স্বাধীন বলে দাবি করি। শুধু ব্যক্তি- স্বাধীনতার দিক থেকে নয়, সভ্যতা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষের যুগে আজ দেশ স্বাধীন। গণতান্ত্রিক দেশ আমাদের।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে, একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৭ বছর পর আজ আমরা একটি প্রশ্নের মুখোমুখি, "আমরা কি সত্যিই স্বাধীন ?" স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ কি একটি দেশকে কেবলমাত্র বিদেশি কবল থেকে মুক্ত করা? নাকি, আরও কিছু জড়িত এই স্বাধীনতার সাথে? স্বাধীনতার সঠিক অর্থ এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থান আমাদের এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক- অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতার কিছু ভূমিকা সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হলো।
গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার নির্বাচনের অধিকার আমরা পেয়েছি, যা আমাদের একটি রাজনৈতিক স্বাধীনতা। তবে এই স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয় তখনই যখন সেখানে উঠে আসে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং খানিক অংশে একটি স্বার্থপর রাজনৈতিক চালচ্চিত্র যখন ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে দেখা যায় সাধারণ মানুষের অধিকার এবং মতামত প্রায়শই অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। আর এমতাবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে সংশয় জাগে, প্রশ্ন ওঠে।
আবার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ভারতবর্ষ একটি সংস্কৃতি, ধর্ম এবং বহুবিত ভাষার মিলনস্থল। কিন্তু আজ স্বাধীনতার বহু বছর পরেও এবং একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসে আমরা দেখি, সামাজিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা আমাদের সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করে একটি বিভাজিকার দেওয়াল তুলে রেখেছে। জাতিভেদ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, এবং, লিঙ্গ বৈষম্য সমাজের প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার অভাবের উপস্থিতি কিন্তু বড্ড চোখে পড়ে।
আবার স্বাধীন ভারতবর্ষে দারিদ্র্যতা,শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, স্বজন-পোষণ, সম্পদের অসমবন্টনের চিত্র যখন ধরা পড়ে তখন কি তা আক্ষরিক অর্থে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সূচিত করছে,? স্বাধীন ভারতবর্ষের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ আজও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের উন্নতি ঘটলেও তার হয়তো সীমাবদ্ধতা এখনো দৃশ্যমান। স্বাধীন ভারতের অনেক মানুষই তাদের মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তবে সবকিছুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা। যেদিন পুরোনো ধ্যানধারণা,কুসংস্কার এবং সংরক্ষণশীল মানসিকতার বেড়াজাল থেকে মানুষ বেরিয়ে এসে একটি নতুন সমাজ গড়তে পারবে সেদিনই মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে সমাজের বুকে। স্বাধীন দেশে একটি উন্মুক্ত সমাজ তৈরি হবে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনাতে মানুষ নিজেদেরকে এগিয়ে রাখলেও এখনো সমাজের বৃহৎ অংশে কিন্তু এই চিন্তা ভাবনার সীমাবদ্ধতা বেশ লক্ষ্যণীয়।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় এবং স্বাধীনতার ৭৭ বছরের পরবর্তী সময়ে বলা যেতে পারে যে, স্বাধীনতা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক মনোভাবের সাথে জড়িত যে মনোভাব উন্নত মানসিকতা ও মনের উন্মুক্ত দ্বারগুলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নাগরিক সচেতনতার বৃদ্ধি ঘটিয়ে, শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, বৈষম্য ও কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে এমন একটি সুন্দর সমাজের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে থাকবে স্বাধীনতা শব্দটির যথার্থ অর্থ ও তার মর্ম। সেদিনই আমরা বুঝতে পারব স্বাধীনতার যথার্থ অর্থ এবং বলতে পারব ,"হ্যাঁ, আমরা স্বাধীন"।
আজ স্বাধীনতার ব্যাপ্তি রাজনৈতিক থেকে অর্থনৈতিক, মানুষের মানসিকতা, চিন্তাভাবনা, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে এগুলির ওপর গুরুত্ব প্রদান করা উচিত সকলের, যা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধময় করে স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ আক্ষরিক অর্থে অনুভব করতে সাহায্য করবে।
সবশেষে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ ও গভীর উপলব্ধির কথা বর্ণনা করা যায়,---
"Where the mind is without fear and the head is held high; where knowledge is free;
Where the world has not been broken up into fragments by narrow domestic walls;....
.... Where the mind is led forwarded by thee into ever-widening thought and action; into that heaven of freedom, my Father, let my country awake...."

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com