সত্যিই স্বাধীনতা, নাকি শুধুই একটি দিন
"স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক ভাবে অর্জিত হয় না, সামাজিক এবং মানসিক দাসত্বের মুক্তি পেতে হবে।" - বাবা সাহেব আম্বেদকর
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতের প্রত্যক্ষ শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয়। তারপর থেকে শুরু হয় শাসন ও শোষণ। অতঃপর সেই শুভক্ষণ আসে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট, যে দিন ভারত ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা পেতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াই করে। হারাতে হয়েছে অনেক ভারতমাতার বীর সন্তানকে। এ লড়াই ছিল দেশের জন্য, দশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। এ লড়াইয়ে না ছিল ধর্মের ভেদাভেদ, না ছিল জাতিহিংসা। এই দিনটি ভারতীয়দের জন্য গর্ব এবং সাফল্যের প্রতীক। ভারত স্বাধীনতার ৭৮ বছর পূর্ণ করল,তবে প্রশ্ন উঠতে পারে," আমরা কি আদৌ স্বাধীন ভারতে বসবাস করছি? আমরা কি আদৌ স্বাধীন"?
" এই স্বাধীন ভারতে আমরা এখনো পরাধীন" - এই বাক্যটি ভারতীয় সমাজে প্রায়শই ব্যবহৃত হয় যা আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে প্রেরণা দেয়। স্বাধীনতা অর্জনের পরে, আমরা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার মুখ দেখেছি, কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং মানসিক দাসত্বের কিছু রূপ এখনও বিদ্যমান। স্বাধীনতার অর্থ কেবলমাত্র রাজনৈতিক মুক্তি নয়, এটি সমাজের সকল স্তরে মুক্তির প্রত্যাশা এবং নিশ্চয়তা। বর্তমান সময়ে, কিছু গুরুতর সমস্যা আমাদের সমাজকে বিপর্যস্ত করে তুলছে যা সমাধানযোগ্য কিন্তু চ্যালেঞ্জিং।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা একটি মৌলিক সূচক। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারত একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্তর কি যথাযথ ভাবে কার্যকর হচ্ছে? রাজনীতি এবং প্রশাসনের নানা স্তরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং জনগণের মধ্যে মতবিরোধ প্রায়ই দেখা যায়। বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই অতীত ভারতকে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। এখন নতুন করে শুরু হয়েছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নিয়ে রাজনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে রাজনীতি।
সামাজিক দাসত্বের দিক থেকে, জাতিভেদ ও সামাজিক বৈষম্য এখনও আমাদের সমাজে রয়ে গেছে। অন্ন, বস্ত্র, এবং বাসস্থানের অভাবে অনেক মানুষ এখনও দুঃখজনক পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করছে। এছাড়াও, নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা নিয়ে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হয় অনেক মানুষ। আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা এক প্রকারের আধুনিক দাসত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।
বর্তমান যুগে আমরা প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনও আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু একথাও সত্য, কিছু সমস্যার সমাধান এখনও বাকি রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো স্বৈরাচারী অত্যাচার। ভারতে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায়বিচার হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুমকি এসেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের চেষ্টা এবং সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বৈরাচারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতন এবং প্রতিরোধের প্রয়োজন।
বর্তমানে নারী নির্যাতন ও শিশু অত্যাচার একটি গভীর সমস্যা। নারীদের ও শিশুদের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। আমাদের সমাজে, অনেক সময়ই নারীদের নির্যাতনের শিকার হতে হয় এখানে শিশুরাও ব্যতিক্রম নয়। এটি একটি সমাজের অন্ধকার দিক যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনকেই প্রভাবিত করে না, বরং সামগ্রিক সমাজের প্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের নারী - সম্পর্কিত নির্যাতন একটি বড় সমস্যা । যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, এবং অন্যান্য প্রকারের নারী নিগ্রহ প্রায়শই সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। সব স্তরের মহিলাদের এই ধরনের হিংসার শিকার হতে হয়।
এই অত্যাচারের প্রভাব শুধু নারী সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পুরুষদের মনোভাব ও সমাজের সামগ্রিক মানসিকতার উপরও প্রভাব ফেলছে। যে সমস্ত নারীরা অত্যাচারের শিকার হন, তারা প্রায়ই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এতে করে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং সামাজিকভাবে তাদের অংশগ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায়।
এই অত্যাচারের মূল কারণগুলো অনেক বৈচিত্র্যময়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ত্রুটি এবং সামাজিক সচেতনতার অভাব এই সমস্যার মূলে রয়েছে। সঠিক বিচার ও কঠোর শাস্তির অভাবের কারণে অনেক সময় নির্যাতিতা নারীরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। প্রথমত, সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। নারীদের বয়সের সাথে সাথে তাদের গুরুত্ব ও সক্ষমতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। এর পাশাপাশি, শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরের অংশগ্রহণ জরুরি। বর্তমানে , ভারতের এসিড আক্রান্ত নারী, মহিলা চিকিৎসক, চাকুরীজীবী মহিলা,গৃহবধূ ,ছাত্রী, সাধারণ নারীর প্রতি সহিংসতা ও অত্যাচারের শিকার হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। একটি সদ্য ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ২০২৪ সাল ৯ অগাস্ট পশ্চিমবাংলায় কলকাতা শহরে একজন মহিলা চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করার মর্মান্তিক ঘটনা ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। তবে এই রকম ঘটনা এই প্রথমবার নয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীদের অবদান অসামান্য হলেও, কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে বহু মহিলা চিকিৎসক বিভিন্ন ধরণের অত্যাচার ও হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। যৌন হয়রানি, মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে শারীরিক হুমকি পর্যন্ত তারা বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের দ্বারা অবমাননা, রোগীদের আত্মীয়দের দ্বারা আক্রমণ এবং প্রশাসনিক সহায়তার অভাবও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক মহিলা এই ধরনের ঘটনার শিকার হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রতিবাদ করার সাহস পান না, কারণ তারা ভয় পান যে, এতে তাদের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রশাসনিকভাবে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেমন— কর্মস্থলে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, দ্রুত হেল্পলাইন চালু করা, এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার সহযোগিতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।।একসাথে কাজ করে আমরা একটি সুস্থ ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গঠন করতে পারি, যেখানে সকল নারীর অধিকার ও সম্মান সুরক্ষিত থাকবে।
সমাজে ছাত্র ছাত্রীদের আত্মহত্যা বা খুনের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। কত যে মা সন্তানহারা হয়েছে তা বলা কঠিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুণগত শিক্ষার অভাব, উচ্চশিক্ষার ব্যয়, সামাজিক চাপ, রাগিং এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনতার পরিসরকে সীমিত করে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যেমন দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে আচরণ, এই সমস্যাকে প্রকট করেছে।
চিকিৎসা সেবা গাফিলতি দেশের স্বাস্থ্য সেবার একটি গুরুতর সমস্যা। শহরের এবং গ্রামের সরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে জটিল চিকিৎসা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা অভাব, অপর্যাপ্ত উপকরণ এবং অবস্থাপনা এই সমস্যাগুলির জন্য দায়ী। চিকিৎসা খাতে সংস্কার ও আধুনিকায়ন জরুরি। আবার অন্য দিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার খরচ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে নাগালের বাইরে।
অর্থনৈতিকভাবে, আমরা একটি প্রগতিশীল অর্থনীতির কথা বললেও, সম্পদবন্টনের বৈষম্য একটি গুরুতর সমস্যা। প্রান্তিক জনগণের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক সুযোগ, এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। কর্পোরেট ও বড় ব্যবসার দ্বারা ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য বাড়ছে, যা সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটি বাধা।
বেকারত্ব ভারতীয় সমাজের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, তবুও যথেষ্ট সংখ্যক চাকরি সৃষ্টি হচ্ছেনা, বেকারত্বের কারণে যুব সমাজ হতাশ এবং অপরাধমূলক কর্মকান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আরও উন্নত চাকরি সৃষ্টির পরিকল্পনা এবং দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
স্বাধীন ভারতের পর থেকে জিনিস পত্রের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি এবং শিল্পখাতের সংকট, বাণিজ্যিক মুনাফা, এবং মুদ্রাস্ফীতি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এটি সাধারণ মানুষের জীবনে চাপ সৃষ্টি করেছে, কারণ তাদের দৈনন্দিন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং জীবনযাত্রার মান প্রভাবিত হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, যেমন বিভিন্ন সংস্কৃতির উদযাপন ও প্রচলিত প্রথার রক্ষণাবেক্ষণ। তবে এই মুক্তির সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যেমন ধর্মীয় বিভাজন এবং সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতার অভাব।
মানসিক দাসত্বের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। প্রচলিত সংস্কৃতি ও সমাজের চাপ অনেক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তা ও মতামতের স্বাধীনতা সত্ত্বেও, সামাজিক চাপ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব মানুষের মনের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে।
অতএব, স্বাধীনতার সত্যিকার মূল্য উপলব্ধি করতে হলে আমাদের সমাজে বিদ্যমান এসব দাসত্বের দিকে নজর দিতে হবে। শুধু মাত্র কোনও দিবস উদযাপনের মধ্যে আটকে থাকবে না।সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগগুলির মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার মান বাড়ানো, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার উন্নতি, এবং জাতিগত ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে আমাদের সমাজকে আরও উন্নত এবং সাম্যবাদী করে তোলা সম্ভব।
হয়তো এই ধরনের উদ্যোগই প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিতে পারে, যা আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সত্যিই মুক্তির অনুভূতি প্রদান করবে। তবু স্বাধীনতা উৎসবে মধ্যরাত থেকে মেতে উঠবেন নেটনাগরিকরা। গোটা দেশের সোশ্যাল মিডিয়া ভার্চুয়ালি ভাসবে উদযাপনের জোয়ারে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাধীনতার আমেজ ভাগ করে নেওয়ার ঢল দেখা দেবে। এইগুলো কোনোটাই মন্দ নয়। কিন্তু সকল ভারতবাসী কি একবার ভেবে দেখবেন আমরা সত্যি কি স্বাধীন?? এইতো আমাদের পোড়া দেশের স্বাধীনতার ছবি। ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি, আর মৌলিক অধিকার হনন বর্তমান ভারতবর্ষকে আবারও সেই ইংরেজ শাসনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। " স্বাধীনতা" শব্দের অবমাননা করা হচ্ছে। স্বাধীনতা দিবসের দিনে সন্ধেহ হয়, সত্যি আমরা "স্বাধীন" তো??