Logo
logo

সাহিত্য / কবিতা

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ

বাংলায় বারোটা মাস - বৈশাখ,জৈষ্ঠ‍্য,আষাঢ়,শ্রাবণ,ভাদ্র,আশ্বিন,কার্তিক,অগ্রহায়ণ,পৌষ,মাঘ,ফাল্গুন ও চৈত্র।বৈশাখ মাস দিয়ে শুরু হয় বাংলা মাসের ক‍্যালেন্ডার।পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ প্রথম মাসের প্রথম দিন।সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।কারন এই দিনটিতেই প্রত‍্যেকটি বাঙালির ঘরে ঘরে পালন করা হয় বর্ষবরণ উৎসব।
আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়।
পয়লা বৈশাখ এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।আগে কিন্তু এমনটা ছিল না।সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক কাল আগে থেকেই পালিত হতো।এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালন করা হত।ইংরেজি ক‍্যালেন্ডার হিসাবে আগে ১৪এপ্রিল,এখন ১৫ এপ্রিল এই পয়লা বৈশাখ পালন করা হয়।
কথায় বলে,বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন।প্রত‍্যেকটি উৎসবের মতো এই বিশেষ উৎসবটির সঙ্গে বাঙালির আবেগ ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত।
পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ঘোষণা করা হয় সরকারি ছুটি।নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
এই নতুন ও বিশেষ দিনেই ব‍্যবসায়ী সম্প্রদায় তাদের ব‍্যবসাকে আগামী দিনে আরও উন্নত ও আরও সফলতা কামনায় সিদ্ধিদাতা গণেশ মা লক্ষীর পুজো করে থাকেন।সঙ্গে খোলেন হালখাতা।
তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল এই হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত সোনার দোকানে।
এই উপলক্ষ্যে নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিকা আঁকা হয়ে থাকে।কোন কোন দোকানে হালখাতা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিতরণ করা হয় সুস্বাদু মিষ্টির বাক্স ও নতুন বছরের বাংলা ক‍্যালেন্ডার।
চৈত্রের শেষ দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন,এই দুইয়ের মেল বন্ধন হল পয়লা বৈশাখ।সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষ্যে চড়ক পুজো অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে আরাধ্য দেবতার সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন।
এছাড়া, বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত।প্রতিটি বাঙালি বাড়িতে নানারকম সুস্বাদু রান্নাবান্না ও একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ানোর মধ‍্যেই লুকিয়ে থাকে উৎসবের মাধুর্য‍্য।পুরুষদের ধুতি পাঞ্জাবী ও মহিলা আটপৌঢ়ে করে পড়া শাড়িতে উঠে আসে তৎকালীন বাঙালি ঐতিহ্য যা এখনও গর্ব ও অহংকারের সাথে বহন করে চলে সমগ্র বাঙালি জাতি।
গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য প্রাঙ্গনে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। আগেকার সময় পয়লা বৈশাখের দিনে জমির মালিকরা নিজের অঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ করতেন। পরে উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পরে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে মন্ত্রপাঠপূর্বক গঙ্গাস্নান করে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন।
পয়লা বৈশাখের এই শুভ দিনে শুধু একটাই কামনা,"এভাবেই দুধে ভাতে থাক সকল বাঙালি,বেঁচে থাক বাংলার গৌরব,ছড়িয়ে পরুক বাঙালির নাম পৃথিবীর প্রতিটা কোণে,উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক বাঙালির নাম ইতিহাস থেকে বতর্মানের প্রতিটি পাতায়।তবেই না পয়লা বৈশাখের আবেগ ধরা থাকবে প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে।কোন কালবৈশাখী ঝড় এসেও ধুলোর মতো ওড়াতে পারবে না বাঙালি জাতিকে।সব শেষে বলব,আমি গর্বিত,আমি বাঙালি।"

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com