স্বাধীনতার প্রহসন
১৯৪৭-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে দীর্ঘ কয়েক বছর পাড়ি দিয়েছে। প্রায় ২০০ বছর পরাধীন থাকার পর ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল স্বাধীনতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অনেক প্রতিকূলতাকে লঙ্ঘন করে বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। প্রত্যেকেরই স্বপ্ন ছিল স্বাধীন দেশ দেখার। স্বাধীনতার স্বাদ নেবার। যারা নিজেদের মূল্যবান প্রাণ দান করেছিলেন দেশের জন্য ,তাদের বেশিরভাগ মানুষই এই স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে যেতে পারেননি।
আচ্ছা স্বাধীনতা মানে কি? স্ব-অধীন থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নাকি নিজে অধিকার রক্ষার জন্য লড়াইয়ে সামিল হওয়া ,নাকি ঘটা করে পতাকার উত্তোলন করা তার সাথে গরমাগরম ভাষণ দেওয়া দেশের? উন্নতি হোক বা না হোক নিজেদের আর্থিক সামাজিক উন্নতি হলেই হল। তা যেভাবেই হোক না কেন। এই জাতীয় ছুটি পালন করা হয় ।সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি প্রদর্শন করার রীতি বহুল প্রচলিত ।কিছু হোক বা না হোক ছবি আপলোড করেই আমজনতা ঝেড়ে ফেলতে চান নৈতিক দায়িত্ব ,কর্তব্য।এখন আবার ছবি পোস্ট করে বিশেষ পোশাক পরিধান করেশ দেশের প্রতি ভালোবাসা উঠলে ওটার প্রয়াস মাত্র ।এসবের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাইবার অপরাধ।স্বাধীনতার উপরি পাওনা আরকি।
স্বাধীনতার গুরুত্ব- মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষদের শ্রদ্ধা জানানো।দেশত্মবোধক সংগীতের মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসা অর্পণ করা হয়। আরেকটি প্রধান গুরুত্ব হল দেশের তরুণদের জাগরিত করা। দেশের ভবিষ্যত তো তরুণরা অর্থাত যুব সমাজ। তাই দেশের উন্নতি সাধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করা ও তাদের মধ্যে সচেতনা জাগ্রত করাই প্রধান উদ্দেশ্য। দেশে প্রেম ও স্বাধীনতা দিবস নিয়ে আমাদের বাড়তি আবেগ কাজ করে। ৭৭ বছর কোন বিদেশী শক্তি আমাদের শাসন করতে পারেনি। তবে দেশের মধ্যে কিছু শক্তি রয়েছে যারা জনসাধারণের মতবাদকে তারা-------
যে বিশ্বাসগুলোর ভিত্তিতে স্বাধীন ভারত গড়ে উঠেছিল সেগুলো আজ আর নেই ।বর্তমানে আমাদের স্বাধীন মতবাদ ব্যক্ত করার অধিকার নেই। দলবাজি ভীষণভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে। শাসকদলের হয়ে কথা বললে ভালো তা না হলে তুমি শাসকদলের চক্ষুশীল হয়ে দাঁড়াবে। নানা অছিলায় তারা তোমাকে টিকতে দেবে না। আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার ক্ষমতা আছে ।তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে দেশ। স্বাধীন হবার দুই দশক সকল দিক ঠিকঠাক ভাবে চালনা করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল ।দিন যত গড়িয়েছে সমস্ত ব্যবস্থায় অব্যবস্থার যে রক্তচক্ষু দেখা গেছে তথা ক্রমে ক্রমে বেড়েছে। সর্বদা আমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর প্রচেষ্টা চলছে ।আইনকে ভাঙার চেষ্টা চলছে। আইনজ্ঞরা নিশ্চুপ থেকে গেছে। কোন প্রতিবাদ করেনি ।বর্তমানে জাতি, ধর্ম ,বর্ণ বিষয়গুলি বিশেষভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে। যা আগেও ছিল যদিও। শ্রেণীবিভাগে মনোনিবেশ বেড়েছে।এই ছোটখাটো সব বিষয়েই বর্তমান রাজনীতির গন্ধ পাই। সবাই নিজের স্বার্থ গোছানোই ব্যস্ত ।তাতে কেউ খেতে পেলও কি না , তাতে কারো কিছু আসে যায় না ।চলছে গদি লড়াইয়ের দ্বন্দ্ব। গদিতে টিকে থাকার প্রয়াস, তা যেভাবেই হোক। প্রাথমিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ,শিক্ষা আর স্বাস্থ্য। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা সবই বিঘ্নিত ।দেশের শিল্প গঠন হচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানির উপর দিন দিন নির্ভরতা বাড়ছে। আমাদের পুঁজি খাটিয়ে তারা লভ্যাংশ নিজের দেশে নিয়ে চলে যাচ্ছে। না তার দিন যত এগিয়েছে প্রেক্ষাপট ততই বদল হতে থেকেছে।
স্বাধীনতার জন্য লক্ষাধিক স্বাধীনতার সংগ্রামী তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে এদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের স্মৃতিতে রয়েছেন কেউ কেউবা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে ।ছাত্রাবস্থা থেকেই দেশমাতৃকার উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। ৭৭ বছর পেরিয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে আজ ও দেশের মহিলারা কি স্বাধীন হয়েছে? এই প্রশ্ন থেকেই গেছে। সম্প্রতি একটি ঘটনা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আর জি কর নামক এক সরকারি হাসপাতালের একজন মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা। এই ভয়াবহ ঘটনায় তাজ্জব দেশবাসী। হাজার প্রশ্নের ঝড় বাঁধ ভেঙেছে ।মহিলাদের কি চিরকাল নির্যাতনের শিকার হতে হবে? তারা কি চিরকাল পরাধীনতার অন্ধকারে আবদ্ধ থাকবেন? দেশজুড়ে জোরদার আন্দোলন চলছে। দেশে-বিদেশে মহিলারা এগিয়ে এসে প্রতিবাদের স্বর তুলেছেন। নির্ভাবনায়, নির্বিঘ্নে কি চলাচল করতে পারবে তারা? রাতবিরোতে একা চলাচল করা নারী যদি তার জীবনের নিরাপত্তা না পায় তবে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নের মুখে।
এবার আসি আসল বক্তব্যে। স্বাধীনতার পরবর্তী এত বছর আমাদের প্রত্যেকের মনে একটাই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে আমরা সত্যি কি স্বাধীন? দেশের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসের ভারতের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশ যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে তার জন্যও কিন্তু দুঃখ হয় ।এই ভেবে যে আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের দেশেই সুরক্ষিত নয় । এই সত্য কখনোই এড়িয়ে যাবার নয়। দেশের কু-কীর্তিকারীরা বহাল তবিয়াতে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় ।আর কোন মেয়ের উপর কোন রকম অত্যাচার হলে তার জন্য নারীকেই দায়ী করা হয় ,কিন্তু কেন?
এই স্বাধীনতার জন্য লক্ষাধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন। অনেকে শত কষ্ট সহ্য করে আজীবন কারাগারে থেকেছেন। সেসময় প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা জাগরিত করার চেষ্টাও চলেছিল। নিজ নিজ মূল্যবোধ জাগরিত করা ই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। মানুষ নিজ নিজ স্বাধীন মত প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।সে তার কর্ম জগতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান টুকু পাবে।দিনের সাথে সাথে স্বাধীনতার পরিবর্তন ঘটেছে।সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে,অত্যাচার, অবিচার অরাজকতা।পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন,ধর্ষণ আর শ্লীলতাহানির মত ঘটনা।এসবের জন্যই কি শহীদেরা তাদের মূল্যবান প্রাণ দিয়েছেন?এদেশের তথা রাজ্যের প্রশাসন ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।সরকার নানা করাপসনে মাথা গুঁজেছে।আম জনতা আজ অসহায়।দিকে দিকে অসহায় বাবা মায়ের হাহাকার। বিচার ব্যবস্থার অধঃপতন।মানুষ কোথায় যাবে?কার দোড়গোড়ায় গিয়ে কড়া নাড়বে? সবার মনে একটাই প্রশ্ন, এই স্বাধীনতা ই কি আমাদের কাম্য ছিল?
শিক্ষা ব্যবস্থায় দূর্নীতি নীচ থেকে উপর তলা পর্যন্ত ভরে গেছে। মাসের পর মাস পথে বসে বিক্ষোভ চলছে শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের। দিনের পর দিন অনশন করছে ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য। অথচ সকলেই নিশ্চুপ। কোভিদের সময় যে ডাক্তারেরা নিজেদের প্রাণ সঙ্কটে রেখে মানুষরূপী ভগবান আখ্যা পেয়েছেন তারই আজ নিজেদের অপরাধ ঢাকতে তৎপর।বাহ্ স্বাধীনতা বাহ্।আর তাই এসব সহ্য করতে না পেরে প্রাক স্বাধীনতার রাতে নারীরা দল বেঁধে একত্রিত হয় কলকাতার অলিতে গলিতে।সবার একটাই স্লোগান- জাস্টিস ! আজ মানুষের এই সংঘবদ্ধতার দরকার ছিল। মানুষ তুমিই আর ঘুমিয়ে থেকোনা এবার জাগো।নিজের প্রতিবাদ নিজে করো ।
অবশেষে বলি, মেয়েরা স্বাধীন হবে সেদিন যেদিন নারী-পুরুষের অধিকার খাতায়-কলমে নয় বরং বাস্তবে সফল হবে। মহিলাদের বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়, তাদের পোশাক সম্পর্কেও নিষেধাজ্ঞা থাকে। কিন্তু কোন ছেলেদের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা থাকে না ।এই বৈষম্য আজকের যুগে বেমানান। চিরকাল মহিলাদের ভোগ্য পণ্য হিসেবে ভেবে এসেছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ।২০২৪ এসেও মানুষের মন-মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি ।নামে আমারা স্বাধীন দেশে বসবাস করি ।কিন্তু স্বাধীনতার আঁচ মহিলাদের এখনো বাঁচাতে পারেনি।নারী মানেই সে ভোগের বস্তু ,তা বারংবার প্রমাণিত। কন্যার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য নানা আইন ব্যবহার বেরিয়েছে। কন্যাকে রক্ষা করার দায় কেউ নিচ্ছে না ।নারী যদি না থাকে সংসার যে একেবারে অচল হয়ে যাবে সেটা অবোধ মানুষেরা বোঝেনা ।আইন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে ।দেশের শাসন বলে কিছু নেই ।দিন দিন জাত পাতের ভিত্তিতে রাজনীতি হয়ে চলেছে। স্বাস্থ্য ,শিক্ষার তলায় গিয়ে ঠেকেছে। ফলে বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মরেছে । অসহায় মানুষদের নিয়েও রাজনীতি করতে মানুষ কখনো ছাড়েনি। এর জন্যই কি দরকার ছিল আমাদের স্বাধীনতা? এর চেয়ে আমরা পরাধীন হয়তো ভালোই ছিলাম । স্বাধীন দেশে তোমার নিজের মত প্রকাশের অধিকার নেই ।কি দরকার এ রকম এক স্বাধীন দেশের একজন নারী হিসেবে বেঁচে থাকার? বাঁচার কোন অধিকার তোমার নেই ? এরকম স্বাধীন দেশ কখনো চাইনি আমরা যেখানে গণতন্ত্র আজ ভূলুণ্ঠিত।
এখানে গায়ের জোরে সব হয়।শুধুমাত্র স্বাধীন ভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেনা দুর্নীতির ঘেরাটোপে দাউ দাউ করে জ্বলছে স্বাধীন ভারত । যা আমাদের আদরের ভারত। ভাবতে লজ্জা হয় সত্যিই আমরা ভারতে বাস করি।
আমরা আশা রাখবো আমরা এই রাজনৈতিক সামাজিক আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শুধু মাত্র কোন দিবস উদযাপনের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখবো না। সঠিক পথে উন্নয়নের কথা ভেবে অগ্রসর হতে হবে। স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। নানা আইনের মাধ্যমে বিল বিচারের আইনে অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের জাতীয় জননেতা নেত্রীরা অবশ্যই এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবেন আশা রাখি। সঠিক মূল্যবোধ এবং আদর্শের চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে কোন কিছুই বদলানো সম্ভব পর হবে না। মহিলাদের ন্যূনতম নিরাপত্তা আজ প্রশ্নের মুখে সেখানে একজন নারী হিসেবে নিজেকে স্বাধীন বলতে দ্বিধা বোধ হয়। বিপ্লবীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা। গর্ব করে বলি আমরা স্বাধীন সত্যিই কি আমরা স্বাধীন?
আজ সমগ্র দেশ জুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে ।শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে নারী সুরক্ষার যে আন্দোলন চলছে সেটা চালিয়ে যেতে হবে ।থেমে গেলে চলবে না। সকল জনগণকে এক হতে হবে।প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে যতদিন না দেশ থেকে অরাজকতা ,অপরাধ ও দুর্নীতি মুক্ত দেশ গঠন না হয়।