গল্প - তাল ক্ষীর
সতীশ আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল জ্বরে পরে আছে ঘরেতে।সাথে প্রচন্ড কাশি।কাশলেই রক্ত বেড়োচ্ছে গলা থেকে।কিন্তু ডাক্তার দেখাবার পয়সাটুকু নেই।কাজে যেতে পারেনা।বাবুদের খামারে বা ক্ষেতে খাটলে যা রোজ দেয় তাই দিয়ে প্রতিদিন ফিরতি পথে দুটো চাল নুন তেল কিনে আনে।বৌ যায় সকালে উঠেই দুটো পান্তা মুখে দিয়ে যায় ধান চাল ঝারতে।কখনও বা কারোর বাড়ি বেগার খেটে দুটো রুটি বা চালের কুঁড়ো পায়।এইভাবে ছেলেটাকে নিয়ে দিনচলে যায় তিনজনের সংসারের।এই ছেলের আগে সতীশের একটা মেয়ে হয়েছিল।নিমুনিয়া নিয়ে জন্মেছিল মেয়েটা।জন্মের তিনদিনের মাথায় মারা গেছে।বাঁচাতে পারেনি।চিকিৎসা করানোর অত পয়সা কোথায়? বৌটা পাগলের মতন করতো সন্তান হারানোর শোকে। কিছুদিন পরে কোলে এল এই ছেলে।তারপরে একটু ধাতস্থ হয়েছে বৌ ময়না।ছেলেটার এখন সাড়ে পাঁচ বছর বয়স।ও বোঝেনা গরীর বড়লোক কি? মাঠে বাচ্ছাদের সাথে খেলতে গিয়ে কত খাবারের নাম শুনে আসে।বায়না ধরে মায়ের কাছে।কিন্তু নিরুপায় মা কি বা করবে চোখের জল ফেলা ছাড়া? সন্তানকে না দিতে পারার দুঃখ ময়নাকে কুড়ে কুড়ে খায়।
এর মধ্যে আবার সতীশ অসুস্থ হয়ে পরেছে। হাতে পায়ে ধরে গ্রামের কবিরাজ কাকাকে ডেকে এনেছে ময়না।কয়েকটা শেকড়বাকড় দিয়ে গেছে বেটে খাওয়াবার জন্যে।সময় মত খাওয়াচ্ছেও।কিন্তু সতীশ সেরে উঠছে না।কবিরাজ কাকা বলেছে এটা ক্ষয় রোগ।এর জন্যে ভালো পথ্যি দিতে হবে।না আছে ভালো পথ্যি দেবার ক্ষমতা না আছে ভালো বা বড় কোন ডাক্তার দেখিয়ে অসুধ খাওয়াবার পয়সা।ময়না এসব ভেবে ঘোমটার আড়ালে চোখের জল মোছে।আর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কত কি ভেবে নির্ঘুম রাত কাটায় এক চিলতে দাওয়াটাতে বসে বসে।ভোর রাতে চোখটা লেগে আসছে বুঝে ঘরে ঢুকে ছেলেটার পাশে শুয়ে পরে।সকালে ঘুম ভাঙলে কাজে বেড়াবার আগে চা করে সতীশকে দিতে গিয়ে দেখে সতীশ আর সাড়া দিচ্ছে না।তার কপাল পুড়েছে বুঝতে পেরে চিৎকার করে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে যায়।মায়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় ছোট্টো রিন্টুর।রিন্টু ঘুম চোখে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে ক বার মা কে ডাকে তারপরে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় রাস্তাতে। যাকে সামনে পায় তাকেই কাঁদতে কাঁদতে বলে তার মা আর বাবা সাড়া দিচ্ছে না।ক্রমশঃ লোক জন জড়ো হয় ভাঙা কুঁড়ের সামনে।ময়নাকে পাশাপাশি ঘরের মেয়ে বৌ রা জল দিয়ে জ্ঞান আনে।সতীশকে সৎকার করতে নিয়ে যাবার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।আসলে সবাই জানে সতীশের শ্রাদ্ধে ভালো মন্দ খাবার সম্ভবনা নেই।আর কাঁধকাটদেরও তেমন কিছু পাওনা জুটবে না শ্মশানে গিয়ে।তাই সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে।যা হোক করে হাতে পায়ে ধরে ময়না চারটে লোক জোগাড় করে সতীশ এর দাহ কার্য সম্পন্ন করলো।বাজারে দেনা করেই কোন রকমে শ্রাদ্ধ করলো।
এদিকে শ্রাবণের জলে ঘরের চালের একটা দিক ভেঙে গেছে।হুড়হুড় করে জল ঢুকে ঘর থৈ থৈ করে ভেসে যাচ্ছে।গ্রামের শেষ প্রান্তে ভাঙা ঘরে ময়নার গরীবের সংসার।
ভাদ্রমাস পরতেই সবার বাড়ি থেকে তালের নানা পদের গন্ধ ভেসে আসছে।ছেলেটাও বায়না করছে তালের বরা খাবার জন্যে। তাল না হয় এদিক সেদিক থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসবে।কিন্তু তেল চিনির জোগাড় হবে কোথা থেকে? ছেলের কান্না দেখে ময়নার বুকটা হু হু করে উঠলো।
ময়না বাবুদের বাড়িতে সেদিন কাজে গেছে কর্তা মা বললেন সামনে জন্মাষ্টমী খান পাঁচেক বড় আর ভালো দেখে তাল দিয়ে যেতে।আরও বললেন যা পয়সা লাগে তিনি দেবেন।কিন্তু তাল যেন ভালো হয়।ময়না মনে মনে ভাবলো ভালোই হয়েছে কর্তা মা কে তাল বেচে কটা টাকা পাবে,সেই দিয়ে ছেলেটার জন্যে তালের বরা আর কিছু ভালো মন্দ রান্না করবে।কতদিন তেমন কিছু খাওয়াই হয়নি ভালো মন্দ।কাজ থেকে বাড়ি ফেরবার সময়ে বিকেলে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই নিভু সুর্যের আলোতে খুঁজে খুঁজে তাল কুড়িয়ে নিল ভালো দেখে দেখে আর বেশ বড় সর সাইজের বেশ কখানা।একখানা নিজের ঘরের জন্যে রেখে বাকী গুলো একটা ঝুড়িতে গুছিয়ে রাখলো পরদিন সকালে কর্ত্তা মা কে বিক্রি করবে বলে।
মাঝ রাত থেকেই ময়নার অসহ্য গা গতরে ব্যথা করছে।পাশ ফিরতে পারছে না।ভোরে চোখ তাকাতে কষ্ট হচ্ছে খুব।উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল,গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে কর্ত্তা মায়ের কাছে তাল গুলো দিয়ে আসতে বললো।কর্ত্তামায়ের থেকে টাকাপয়সা কত নেবে সেটাও বলে দিল।
গ্রামের জমিদার বাড়িতে প্রতিবছরের মত এ বছরেও বড় করে জন্মাষ্টমী পালন হবে।কত লোকজনের নেমতন্ন হবে।সারা গ্রামের উচ্চ শ্রেণীর লোকেদের নেমতন্ন হয়।পাত পেরে বসে কত কিছু খাওয়ানো হয় ভালো ভালো খাবার।কাঙালী ভোজনও হয়।তবে পরের দিনে।সেদিনে অত ভালো ভালো খাবার থাকে না।ছোট্ট রিন্টু এসব কথা গ্রামের লোকের কানাঘুঁসো থেকে শুনেছে।সে মনে মনে ভাবে মায়ের কথামত টাকা না যদি নেয় তাল বেচে,তাহলে নিশ্চই জমিদার বাড়িতে তাদের নেমতন্ন হবে।দুটো ভালোমন্দ খেতে পাবে।তাই সে কর্ত্তামা কে তাল দিতেই কর্ত্তামা যেই কত টাকা দিতে হবে জানতে চাইলো সে হেসে ফেলে লাজুক মুখে বলে," ও লাগবেনি গো মা".... তার সাথে মায়ের জ্বর হয়েছে আসতে পারবে না কাজে সেই সংবাদটাও দিয়ে বাড়ি চলে আসে।
নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরবার পরে মা কে বলে বাবুদের বাড়ি জন্মাষ্টমীতে নেমতন্ন হবে সে খেতে যাবে মায়ের সাথে।কত কি খাবে সেদিন ভালোমন্দ।মা বলে ছাই নেমতন্ন আসবে।তার চাইতে বরং টাকা আনলে তাকে দুটো তালের বরা করে খাওয়াতে পারতো তার মা।কিন্তু রিন্টুর মায়ের ওসব কথা কানে ঢোকে না।সে তখন তার নিজের মধ্যের ভাবনাতেই মশগুল হয়ে থাকে আনন্দে।
পরদিন জমীদার বাড়ির লোক সারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জন্মাষ্টমী র ভোজ খাবার নেমতন্ন করে গেল ঢ্যাঁড়া দিয়ে।কিন্তু রিন্টু দের বাড়ি নেমতন্ন হল না।রিন্টু তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েও ছিল।পাছে ভুলে যায় বলতে, কিন্তু তাও নেমতন্ন হল না তাদের।সে তখন কাঁদতে কাঁদতে কিচ্ছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পরলো।ময়না তখন পাড়ার দোকানে গিয়ে চিনি ধারে চেয়ে আনলো।দোকানী শাসিয়ে বললো দু দিনের মধ্যে আগের টাকা সমেত সমস্ত টাকা শোধ দিতে না পারলে খুব খারাপ হবে।ময়না জানে না কি করে শোধ করবে। ঘরে একটু চালের খুঁত ছিল।ওটা জলে ভিজিয়ে বেটে নিল।তাল ছেঁচে কাথ বাড় করে নিল।এবারে চিনি দিয়ে পাক করে তারক্ষীর বানালো।তারপরে রিন্টুকে তুলে নিল কোলে।নিজের হাতে খাইয়ে দিল তালক্ষীর।ছেলে কোলের কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে খুব আদর করে ঘুম পারিয়ে দিল।তারপরে নিজের আঁচলে গলাতে ফাঁস লাগিয়ে চালের বাঁশ থেকে ঝুলে পরলো।
সারা গ্রামে তখন জন্মাষ্টমীর পুজোর শঙ্খ,কাঁসর-ঘন্টা ধ্বনিত হচ্ছে.….. ময়নার আত্মা তখন ঘুমন্ত কোলের ছেলেকে ফেলে মিলিয়ে যাচ্ছে পঞ্চভুতে।