আগুন পাখি
আমাদের জীবনে উৎসব বহন করে আনে এক অনাবিল আনন্দধারা, যার পরশে ধনী দরিদ্র সকলেই দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে কয়েকটা দিন মুক্তির আনন্দে মেতে উঠি। সন্দেহ নেই উৎসব জীবনের অঙ্গ। সবার রঙে রঙ মিলিয়ে সার্থক হয়ে ওঠে উৎসবের দিনগুলি। উৎসবের সমারোহে আর বৈচিত্রের আঙ্গিকে পরিপূর্ণ এই বাংলার মাটি। নানা জাতি, নানা মত আছে এই বাংলায়। তবুও উৎসবের এই দিনগুলোতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মিলেমিশে এক হয়ে যায় আনন্দ স্রোতে। প্রকৃতি তার নিজ খেয়ালে ঋতু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে উৎসবের দিনগুলোকে মধুময় করে তোলে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। আমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর পরেই আসে কালীপুজো। মা কালী হলেন শক্তির দেবী। মায়ের আরাধনায় যেমন মন্দির ও বাড়িতে ধুমধাম করে হয়, তেমন বারোয়ারি পুজো হয় পাড়ায় পড়ায়। এক এক জায়গায় এক একটি রূপেরই মায়ের পূজো করা হয়। কোথাও শ্যামাকালী, কোথাও চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী, সিদ্ধেশ্বরীকালী, বড়কালী এইভাবে নানা রূপে দেবীর আরাধনা করা হয়। এই পূজার প্যান্ডেলের থেকেও আলোকসজ্জার দিকে থাকে বেশি লক্ষ্য।
এ যেন অন্ধকারকে মুছে দিয়ে আলোর পথে চলার অঙ্গীকার। শুধু পূজামন্ডপ নয়, প্রত্যেক বাড়ি সেজে ওঠে আলোর মায়ায়। রাস্তাঘাট সর্বত্রই আলোয় ঝলমল করে, এছাড়া দীপাবলীর রাতে বাজি ফাটিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ করা হয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই কমবেশি বাজি পুড়ায়। নানা রকম বাজি যেমন শব্দবাজি ফুলঝুরি রকেট চকলেট বোম দড়িবাজি চড়কি বাজি, ইত্যাদি। অবশ্য শব্দবাজি এখন সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আর এক ধরনের বাজি দেখা যায় দীপাবলির রাতের আকাশে, শব্দহীন এই বাজি হলো ফানুস। রাতের আকাশে আগুনের দীপ জ্বলে উড়ে বেড়ায় বিনা ঠিকানায়। এক রাত্রে বাজি পুড়িয়ে মানুষ কোটি কোটি টাকা ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। এছাড়া যে কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করতে, ক্ষুদ্র মাঝারী ব্যবসায়ী নানা রকম সামগ্রী বিক্রি করে সংসারে কিছুটা সুখের স্বপ্ন দেখেন। ফুলমালা থেকে জামা কাপড়, যাবতীয় সামগ্রী বিক্রি করেন, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে। তাই উৎসব মানে শুধু অনাবিল আনন্দ নয়, অনেকের রুজি রোজগার একটা মাধ্যম। তাই উৎসব থাক উৎসবেতেই, ঐতিহ্য আর আধুনিকার সাথে তাই মিলিয়ে বাজিতেও এসেছেন নতুনত্বের ছোঁয়া। আজ শুধু শব্দবাজি নয়, নানারকম বাজি তৈরি হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে, তাদের গল্প নিয়ে এলাম এই কলমে।
গ্রামের নাম হালিমপুর, মুসলিম অধ্যুষিত এই গ্রামে গড়ে উঠেছে বাজি কারখানা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছোট বড় নানা আকারের ঘরে ঘরে বাজি তৈরি হয় সারা বছর জুড়ে। গ্রামের বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী থেকে শিশু শ্রমিকরা এই বাজি তৈরীর কারখানায় কাজ করে। বারুদের স্তুপের মধ্যে দিয়ে দিনের পর দিন কাজ করে রুজি রোজগারের তাগিদে। দু'মুঠো অন্ন জোটাতে এরা জীবনকেই বাজি রাখে।
বাজি কারখানা গুলিতে একটু অসাবধান হলেই মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে মৃত্যু অনিবার্য। তবুও এই সাময়িক আনন্দদায়ী বাজি ফাটিয়ে আমরা কালীপূজা, দুর্গাপূজা, বিবাহ অনুষ্ঠান পালন করি। মাঝেমধ্যেই বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে, তাই গ্রামের ফাঁকা প্রান্তরে কারখানা গুলো রয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই কেউ না কেউ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত, কারু হাত উড়ে গেছে তো কারো পা। সারা শরীরে পোড়ার ক্ষতচিহ্ন। যখন বিস্ফোরণ ঘটে তার তীব্রতা এতটা বেশি থাকে যে, এর আশেপাশের বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ে। আর যে কারখানায় এই দুর্ঘটনা ঘটে সেই কারখানা শ্রমিকদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পরিবারের একমাত্র রোজগারের স্বামীর মৃত্যুতে এদের কিছু করার থাকে না। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও গ্রামের সকলে এই কাজে লিপ্ত হয় কিছু অর্থ উপার্জনের আশায়। আর আমরা টাকা খরচ করে বাজি পুড়িয়ে দীপাবলী উৎসব পালন করি। আলোর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অন্ধকারের শ্রম। বারুদের গন্ধমাখা শরীরের রক্ত ঝরানো শব্দবাজি হয়ে ওঠে আনন্দবাজি।
শব্দবাজি ছাড়াও নানারকম বাজি তৈরি হয়, ফুলঝুরি রং মশাল চরকি তুবড়ি রকেট বাজি ইত্যাদি। এছাড়া কয়েক বছর ধরে ফানুশ নামে এক ধরনের বাজি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দীপাবলীর রাতের আকাশের ফানুসের ভেসে বেড়ানো এক সুন্দর দৃশ্য বহন করে। তবে এই সুন্দরের ধ্বংসলীলাও দেখা যায় প্রতিবছর।
সেদিন ছিল কালীপুজোর রাত, নানা রকম বাজির সাথে তাল মিলিয়ে শব্দবাজি আর ফানুসের সৌন্দর্য দেখে আনন্দে যখন সবাই মেতে উঠেছে তখন এই ফানুস উড়তে উড়তে গিয়ে পরে এক বস্তির উপর। দরমা আর প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি গরীবের বসতি মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, বেশিরভাগ মানুষ সেই আগুনের লেলিহান শিখার কবল থেকে বাঁচতে পারলেও এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলা আর তার দুই বছরের শিশু কন্যা কাল ঘুমের মধ্যে জ্বলন্ত যতুগৃহে দগ্ধ হয়ে পুড়ে মারা যায়। অনেক চেষ্টা করে তার নেশাগ্রস্থ স্বামীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে দেওয়া হয়, কিন্তু শিশুটি তার মায়ের মৃত্যু হয় জলন্ত অগ্নিগ্রাসে। এভাবেই অর্থের বিনিময়ে আনন্দের মূর্ছনায় কত শত প্রাণ চলে যায় তার হিসেব কেউ রাখে না। প্রতিবছর দীপাবলীর রাতে বিকিকিনির হাটে বিকিয়ে যায় কত শ্রম আর গরিবের স্বপ্নের ছোট্ট কুটির।
তবুও উৎসব আসে, আনন্দের সমারোহে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুদূর পানে। শত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনা ভুলে কয়েকটা দিনের সুখ স্মৃতিকে সঙ্গী করে সুখ খুঁজে নিই উৎসবের উৎস হতে। সারা বছরের কর্মজীবনের ক্লান্তি ভুলে পুনরায় নতুন উদ্যোগে কাজে ফিরি আশার আলো বুকে নিয়ে। সময় থেমে থাকেনা, সে চলে যায় নিজ খেয়ালে বছরের পর বছর কালের চক্র বলয়ে।।