ছোটগল্প : মেঘমল্লার
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে । দোতলা বাড়ির খোলা ছাদে একটা বাচ্চা মেয়ে স্বর্গীয় আনন্দে নেচে চলেছে নিজের মনে । ঘরের ভিতর থেকে এ আর রহমানের সেই বিখ্যাত গান টা উচ্চস্বরে বাজছে , "বর্ষ রে মিঠা মিঠা...."! এই হল শ্রাবণী ।
শ্রাবণী এবং প্রণয় দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু , একই পাড়ায় প্রায় পাশাপাশি বাড়িতে থাকে । শ্রাবণীর বয়স পাঁচ , প্রণয়ের সাত । দুই জনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য । অঞ্চলেরই একটি ভালো সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে দুইজনেই ।
পড়াশোনায় খুবই ভালো শ্রাবণী । ভালো লাগার বিষয় , অঙ্ক , ছবি আঁকা এবং বৃষ্টিতে ভেজা ! প্রতিদিনের মত সকালে পড়তে বসেছে । আষাঢ় মাস , তাই রোজই বৃষ্টি হয় , আজও আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো । ব্যস , শ্রাবণী কে আর পায় কে ! একছুটে দো তলার ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলো , শ্রাবণী নির্ভেজাল আনন্দে মেতে ওঠে । পাশের বাড়ীর প্রণয়ও জানে , বৃষ্টি নিয়ে শ্রাবণীর পাগলামি ! সেও চিৎকার করে শ্রাবণী কে উৎসাহ দিতে লাগলো । দুইজনের না চাওয়া পাওয়ার নিষ্কাম ভালবাসা কে প্রকৃতিও উৎসাহ দিতে লাগলো , বৃষ্টির জোর আরও বেড়ে গেলো ।
(কয়েক বছর বাদে )
শ্রাবণী মাধ্যমিক দেবে । অন্যদিকে প্রণয় হায়ার সেকেন্ডারি জন্য তৈরি হচ্ছে । দেহ মনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুইজনের ভালো বাসার এবং ভালো লাগারও পরিবর্তন ঘটেছে । আগের মত খোলামেলা নয় । একটু যেন রেখে ঢেকে চলার আপ্রাণ চেষ্টা ! তাহলে কি এই ভালোলাগার মধ্যে কিছু চাওয়া পাওয়ার শর্তের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ?
বর্ষার বৃষ্টিতে ভেজায় এখনও শ্রাবণী সমান উচ্ছ্বল ! আজও সকাল থেকে সমানে বৃষ্টি পরে চলেছে । প্রণয় আগের মত নিজের বাড়ির ছাদ থেকে চিৎকার করে শ্রাবণী কে উৎসাহ দেয় না । তাই শ্রাবণী কে মোবাইলে ফোন করে জানতে চাইলো স্কুলে যাবে কি না ? শ্রাবণী বলল , আগামী কয়েকদিন স্কুলের ছুটি আছে , সামনেই তো টেস্ট পরীক্ষা , সেই জন্য । তবে বিকেলে কোচিং আছে । বৃষ্টি খুব না হলে যাবে । প্রণয় যেন এই কথাটার অপেক্ষায় ছিল ! সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো , বৃষ্টি হলেও তুই ভয় পাস না । আমি তোকে বাইকে কোচিংএ পৌঁছিয়ে দেবো । চল , অনেকদিন দুজনে বৃষ্টি ভিজিনি । তোর কোচিং শেষ হলে আমরা দুজনে একটু বৃষ্টি তে ভিজবো !
শ্রাবণীর কোচিং শেষ হলো , কিন্তু বৃষ্টির শেষ নেই । প্রণয় আর শ্রাবণী রাস্তার ধারে বাইকে হেলান দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল । ছাতা সাথে থাকলেও , কারুরই মাথায় নেই । শুধু লোকের নজর এড়াতে ছাতা কে ব্যবহার করা । কোথাও যেনো রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে , " এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে , এসো করো স্নান নবধারা জলে"! ছোটবেলার এ আর রহমানের বর্ষার গানেরও উত্তরণ ঘটিয়ে এবার রবি ঠাকুরের পরিণত প্রেমের গীতাঞ্জলি দিয়ে শ্রাবণীর প্রেমের অঞ্জলীর সূত্রপাত ঘটলো । হয়তো শ্রাবণী এবং প্রণয়ের ভালবাসাও সাবালক প্রাপ্ত হল ।
( বেশ কিছু বছর বাদে )
এখন শ্রাবণী এবং প্রণয় , প্রতিবেশী নয় । ওরা আজ স্বামী স্ত্রী । দুজনেই জীবনে ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত । শ্রাবণী এক কলেজের অধ্যাপিকা , প্রণয় সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী । এক পুত্র সন্তানের গর্বিত মা - বাবা । প্রকৃতির নিয়মে আজও বৃষ্টি হয় । কিন্তু আজ বৃষ্টিতে ভিজতে কিছুটা দ্বিধা হয় । ঘরে বসেই শ্রাবণী বৃষ্টির দিকে চেয়ে রবি ঠাকুরের কবিতা বলে ওঠে , "নীল নবঘনে আষার গগনে ...."! বয়সের এবং মনের পরিণত অবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছে ।
সময়ের সাথে বয়সকেও সম্মান জানাতে হল দুজনকেই । কিছু আগে পরে প্রণয় এবং শ্রাবনীকে চাকরি থেকে অবসর নিতে হলো । একমাত্র পুত্র সন্তান বিদেশে প্রতিষ্ঠিত । এখন দুজন দুজনকে অনেকটা সময় দিতে পারে । ঠিক সেই ছেলেবেলার মত । এখনও বর্ষা হয় । শ্রাবণী এবং প্রণয়ের ভালবাসাও এখন ছেলেবেলার ভালবাসার মতোই নিষ্কাম ভালো বাসায় ফিরে এসেছে । এই প্রেম যেন শুধুই দেওয়ার । কোনকিছু নেওয়ার প্রশ্নই নেই !! রবি ঠাকুরের সেই গানই , প্রণয় এবং শ্রাবণীর বেঁচে থাকার মন্ত্র , "আমার যত বিত্ত , প্রভু , আমার যত বাণী ।। আমার চোখের চেয়ে দেখা , আমার কানে শোনা , আমার হাতের নিপুন সেবা , আমার আনাগোনা - সব দিতে হবে । ....
শ্রাবণী এবং প্রণয়ের জীবনে এখন বর্ষা ও প্রেম হয়ে উঠেছে সংপৃক্ত কিন্তু বাঙ্ময়।