Logo
logo

গল্প / কাহিনী

চন্দনবাটার সু'বাস

আজ বিহান বেলা থাইকে রাজডিহা গাঁয়ের ঘরে ঘরে শুরু হঁইয়েছে উলুর আওয়াজ,শাঁখের শব্দ।
সুতনু আর কিছুতেই টিকতে লাইরছে দুদন্ড ঘরটাতে। গটা ঘর-দুয়ার,আইঙনা আজ সোব যেন ফাঁকা খাঁ খাঁ কইরছে।
গায়ে গামছাটা লিয়ে ডবার ধারে ধারে ঘুইরে বুইলছে আজ সুতনু। আগলা বছর মা'টা মইরে গেল পূজার আগুতেই, বছর ঘুইরতে নাই ঘুইরতেই বাপটাও চইলে গেল। গাঁ ঘরের লোক,কুটুমবাটুম দুদিন আহা-উহু কইরল্যেক, তাবাদেই সোব যেকার সেই।
সুতনু বাপ-মায়ের একটাই ব্যাটা, দুটা'বিটির বিয়া-থা বাপ-মায়েই চুকাই দিয়ে গেইছে। লাতিপুতি দেইখে সোব সাধ মিটাইয়ে সুন্দর মরণ সুতনুর বাপ ভৈরবমাস্টরের আর উনার গিন্নির। গাঁয়ের লোক তো ধন্যিধন্যি করে উঁনাদের লিজ্ঝঞ্ঝাট মরণের লাইগ্যে,বলে "বহুত পূইণ্য না কইরলে অমন মরণ হয় না.."।
সুতনুর সংসারও গুছানো-বাগানো পেরাইমারি ইস্কুলের মাস্টার বঠে উ'ও। লেঝ্য-লিতি বাপের লেগেই শিখে বড়ো হইয়েও সুতনু এমন কাজটা কি কইরে যে কইরল্যেক? ইটা ভাইবলেই সুতনুর চইখ জলে ঝাঁপাসাই যাঁছে।
ঘরের চাইরধারে ফুলবাতসা ছড়াইয়ে,সুতনুর বৌ গেল বেটাকে লিয়ে বাপের ঘর। বইলে গেল "ফিরিজে সোব রাঁধে রেখেছি, সোময় মতন লিয়ে খাবে মনেক।"
অইন্যদিন হইলে.তনুও সঙে যাঁতো কিন্তুক এমন দিনে শ্বশুরঘর গেলে বৌএর মান থাইকব্যেক নাই। এই সোব ভাইবত্যে ভাইবত্যেই তনু ডবার ধারে বাপের লাগানো অর্জুন গাছটার লিচে থাপ্সিগাদা দিয়ে বইসলো। আর ভাইবছ্যে কোও একজনাও আইলো নাই আজ। বড়হ বুইন নাইলে বহুদুরে থাকে কিন্তু ছুটুবুইনটা?
কাইল পরশু দুটাদিন কালীমায়ের থানে রাইত জাইগে সুতনুর দু-চইখে তন্দ্রা আইলো।
এমন সোময় কানে বাইজলো - 'দাদা...!
সুতনু ধড়পড়াইয়ে উইঠে দেখে কোউ কুত্থাও নাই। ছুটুবুইন গেল বছর একটা ফোন দিঁয়েছিল এমনদিনেই ।
সেটাও যেন আজ গুম মাইরে আছে।
ফোনটা লাড়েচাড়ে আবার ভুঁয়ে নামাই রাখ্যে আর ভাবে- আমি ফোন কইরবো একবার?
যদি নাই ধরে তখন সে যে আরো লুজ্জা।
বুকের কষ্টে নিজেই লিজেকে বলে-
"এমন লুজ্জা যদি সেদিনকে পাইতম তাইলে সম্পর্কটা এমন হইতো নাই!" সেই অভিমানেই তো ছুটু বুইন মন্দিরা লিঠাকাটা চুকাই দিয়ে গুম মাইরে গেল।
গাছতলেই সুতনু গামছাটাকে মাটিতে পাইতে শুইয়ে পইড়লো। পাড়ার বিটিছিলাগেলা ডাইকেছিলো-
"ও তনুদা হামদের ঘরকে আইসবে ভাইটিকা লিতে।" কিন্তুক যাইতে মনোই হইলো নাই সুতনুর। বড়দিদিটা তড়পায় এমন দিনে ভাইকে পাবার লাইগে, কিন্তুক যাইত্যে লারে তনুু বহুত খরচা।
বাপ-মা মইরে যাবার পর দিদিও আইসত্যে চায় না। কিন্তু ছুটু বুইনটার জন্যে আজ সুতনু মইরে যাছে মরমে। সুতনুর বৌ শক্তপোক্ত গুছাতো মাইয়া।
সাপটায়ে সংসারটাকে আগলাইছে। যা সোব এজমালীর সম্পত্তি, না গুছালে ভাই-ভাইয়াদে লুটেপুটে লিবেক যে। তাই লেগেই তো সুতনু উয়ার কথার অবাধ্য হয় না। বৌ সুতনুকে আনেক বুঝাইছে "হাঁই দ্যাখো দুদিন অমন রাগরোশ হবেক তুমার বুইনদের, তাবাদেই দেইখবে সোব মাইনহ্যে লিবেক। উয়াদের তো যাবার কুথাও লাই, দুদিন যাইতে দাও, সোব সইয়ে যাবেক। তাছাড়া তুমি হছো তুমার বাপের একটা বেটা, ইসোব সম্পত্তি তো তুমারই। সেগেলা লিয়ে তুমি যা খুশি কইরত্যে পারো।" এমনি হাজারো কথা বইলে বইলে বউ সুতনুকে ঠিকই ঠান্ডা রাইখেছিল। কথাগুলা মন্দ লয় যদি বুইনগেলাকে সবটা জানাইয়ে কইরতো। ইসোবকিছু ভাইবত্যে ভাইবত্যে আইজকে সুতনু ভাইঙ্গে পইড়েছে জুমড়া কাঠের পারা। বারবার মনটাতে হইচে- "জমিদিরাত,মা'য়ের গয়নাগাটি যা বিক্রি কইরেছি ইটা যদি বৌকে নুকাইয়েও বুইনগেলাকে টুকু জানাইয়ে রাইখত্যম তাইলে হয়তো এমন দিনটা আর দেইখত্যে হইতো নাই।" সুতনুর দু গাল বেয়ে রো পড়হ্যে। খাঁ খাঁ কইরে উইঠছে মনটা।
দুটা গাঁয়ের পরেই সুতনুর ছুটু বুইন মন্দিরার ঘর। শ্বশুর-শ্বাওড়ি ছিলাপিলা লিয়ে বাড়বাড়ইন্ত গেরস্থ ঘর। জা-জাউলি সোব আইছে। সোবারই ভাই-দাদা আইছে। সাইর দিয়ে আসন পাইতে লম্বা জলবারান্দায় বইসেছে ভাইটিকা লিতে।
মন্দিরার লিজের কুনু ননদ নাই, হাতানো পাতানো একগাদা বুইন আইসেছে টিকা দিতে মন্দিরার বর আর দেওরকে। মন্দিরার বর ভোলা'র বুলুরঙের পাঞ্জাবি থেইকে রইগরইগা সেন্টের গন্ধ বাইরয়াছে। মন্দিরার আজ কুছুতেই কুনু মন নাই,
ফাঁকফোঁকর পাইলেই ঘর আর বাইর কইরছে।
সোব কাজ সারা হইলে কাত্তিকের পড়ন্ত দোফোরের রোদ তুলসীমঞ্চের সামনে লটাগড়ি খাইত্যে আসে। মন্দিরা ঐ খেনে বইসলো টুগদু। খড়মইড়া হইলদা-লাল ছাপা সুতির শাড়ির আঁচলাটাকে মুখে টাইনে গঙাইয়ে কাঁইদে ফেইললো। কাঁদনার আওয়াজে ভোলা ছুইটে আইসে জিগায় "কাইঁদছো কেনে,কি হঁইয়েছে?"
মন্দিরা হাজার চেষ্টা কইরেও চিপত্যে লাইরছে লিজের হড়কাবানের পারা কাঁদনাটাকে।
কাত্তিকের সঞ্ঝায় ঝপ কইরে আঁধার নাইমে আইলো মনির আঁঙ্গনায়। হঠাৎ ভটভটির বুক ভাঙা শব্দ। শব্দটো যত কাছকে আইসছে তত যেনহ বুকের হাপর বাইড়ে যাইছে। মনির শাওড়ি সন্ঝাবেলায় পাথরের আলা হাতে লিয়ে ডাঁড়াইয়ে উঠানের মাঝখেনে। তুলসিমঞ্চের খোপে আলাটা রাইখত্যে যাবেক আর সেই ভটভটির শব্দ আইস্যে থাইমল্যো একবারে মন্দিরার দুয়ারে........
অমাবস্যা কাইট্যে ভাইদ্বিতীয়ার চাঁদ উইঠল্যো যেনহ মন্দিরার উঠানজুইড়ে। মন্দিরা দেইখলো সুতনু আইছে, দাদার কপালটা ধুধু মাঠের পারা ফাঁকা। একটো টিকা পাবার লেইগে মনগুমানী অভিমানের পাহাড় ভাইঙে বুইনের উঠানে ডাঁড়াতেই সব অভিমান জল। দুর থাইক্যে দিনের শেষে ভিডিও কল করছে দিদি সুতনুর ফোনে, জলভর্তি চইখে দেখে সুতনুর কপাল চুঁইয়ে গড়াই পইড়ছে চন্দনবাটার টিকা,তার সুবাস মুঠাফোনে লাইগতেই পরবাস থেকে ভিডিওকলে উলু দিলো দিদি।

<<Prev1234Next>>

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com