প্রবন্ধ - জন্মাষ্টমী পূজো: আমাদের গ্রামের বাড়ির অন্যতম বৃহৎ উৎসব
আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের বাড়িতে জন্মাষ্টমী উৎসবের মহিমা অন্যরকম। প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর দিনটি আসে এক মহা আনন্দ আর শ্রদ্ধার স্রোত বয়ে নিয়ে। এই উৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং পরিবারের বন্ধন, সামাজিক সম্পর্ক আর সংস্কৃতির মেলবন্ধনও বটে।
জন্মাষ্টমী পূজোর প্রস্তুতি শুরু হয় উৎসবের কিছুদিন আগে থেকেই। আমার শ্বশুরবাড়ির সকলে মিলে এ সময় গ্রামটিকে সাজিয়ে তোলে। বাড়ির প্রতিটি ঘর থেকে উঠোন পর্যন্ত সারা এলাকাটা যেন নতুন প্রাণ পায়। দেওয়ালে আলপনা আঁকা হয়, উঠোনে কলাপাতা দিয়ে গণ্ডি কাটা হয়, আর ঢাক-ঢোলের আওয়াজ যেন বাতাসে মিশে যায়। দাদা শ্বশুর-ঠাকুরদার আমল থেকে এই উৎসব চলে আসছে, তাই এই পূজোকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীরতা অনুভূত হয়।
জন্মাষ্টমীর আগের রাতেই আমাদের বাড়িতে ভক্তিগীতি, কীর্তন আর শ্রীকৃষ্ণের লীলা স্মরণ করা হয়। গীতার পাঠ, আর শ্রীকৃষ্ণের জীবনের গল্পগুলো যেন আমাদের সকলকে ভক্তির আবেশে আবৃত করে রাখে। পরিবারের ছোট বড় সবাই মিলে অংশগ্রহণ করে এই আয়োজনগুলোতে, যেন এটি শুধুমাত্র পূজা নয়, বরং আমাদের পরিবারের ইতিহাসের একটি অংশ।
জন্মাষ্টমীর দিন, সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই পূজার আয়োজন শুরু হয়। পুজোর প্রধান আকর্ষণ শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি। আমাদের গ্রাম্য কারিগররা যত্ন নিয়ে এই মূর্তি তৈরি করেন। আমরা সকলে মিলে পূজার উপকরণ সংগ্রহ করি এবং ঠাকুরকে স্নান করানো থেকে শুরু করে সাজানো পর্যন্ত প্রতিটি পর্ব গভীর ভক্তি নিয়ে সম্পন্ন করা হয়।
সকাল থেকেই বাড়ির বড়দের নেতৃত্বে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি শুরু হয়। আমাদের বাড়ির উঠোনে পূজার মন্ডপ স্থাপন করা হয়, যেখানে কৃষ্ণের পাদুকা স্থাপন করে বিশেষ ভক্তিমূলক আচার পালন করা হয়। বাড়ির সকলে নতুন পোশাক পরে পূজায় অংশগ্রহণ করে, এবং উৎসবের মধ্যে একটি আনন্দের সুর বইতে থাকে।
জন্মাষ্টমীর পূজার আরেকটি বড় আকর্ষণ হল প্রসাদ। আমাদের বাড়ির মহিলারা আগের দিন থেকেই বিভিন্ন রকমের মিষ্টান্ন, পায়েস, ক্ষীর ও নানা উপাদেয় খাবার তৈরি করেন। নারকেল নাড়ু, তালের মোহনভোগ, তালের মালপোয়া, মাখন-মিষ্টি, দই-চিঁড়া প্রভৃতি উপাচার দিয়ে ঠাকুরের ভোগ সাজানো হয়। এই ভোগ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, এবং সকলের মুখে প্রসাদ তুলে দেওয়া যেন আলাদা এক তৃপ্তি দেখা যায়।
জন্মাষ্টমীর দিন আমাদের বাড়িতে শুধু ধর্মীয় পূজা নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিলে শ্রীকৃষ্ণের জীবন থেকে বিভিন্ন ঘটনা মঞ্চস্থ করে। রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা, কংসবধ, মাখন চুরি প্রভৃতি দৃশ্যগুলি সুন্দরভাবে অভিনয় করা হয়। ছোটদের নৃত্য, গীত, এবং আবৃত্তি যেন গ্রামের মানুষদের মধ্যে নব আনন্দের সঞ্চার করে।
রাতে যখন শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় আসে, তখন মন্দিরে বিশেষ আরতি ও জন্মলীলার আয়োজন হয়। শঙ্খধ্বনি, প্রদীপ জ্বালানো আর উলুধ্বনিতে পুরো বাড়িটা যেন আলোকিত হয়ে ওঠে। মন্দির থেকে শুরু করে বাড়ির প্রতিটি কোণ তখন আলোয় ঝলমল করে।
জন্মাষ্টমীর দিনটি আমাদের গ্রামের মানুষদের জন্যও বিশেষ এক মিলনমেলার দিন। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনেরা আসেন, গ্রামের মানুষরা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমাদের বাড়ির উঠোনে তখন এক বিশাল ভোজের আয়োজন হয়, যেখানে সবাই মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে।
এই দিনটির মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের মধ্যে এক অন্যরকম বন্ধন গড়ে ওঠে। সবাই মিলে একে অপরের সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করে, এবং আনন্দে মেতে ওঠে।
জন্মাষ্টমীর এই উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের একটি অঙ্গ। দাদা শ্বশুর-ঠাকুরদাদের সময় থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব আজও আমাদের পরিবারের সকলে মিলে উদযাপন করে আসছি। এই পূজার দিনগুলিতে গ্রামের বাড়ির প্রতিটি মানুষ একে অপরের সাথে মিশে এক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করে।
পরিবারের সকল প্রজন্ম মিলে এই উৎসবকে আরও আনন্দময় করে তোলে, আর আমরা সকলে মিলে কৃষ্ণের ভক্তি ও প্রেমের মধ্যে একত্রিত হই। জন্মাষ্টমী আমাদের শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের পরিবারের বন্ধন ও গ্রাম্য সংস্কৃতির প্রতীক।