ছোট গল্প - মিঠুর পয়লা বৈশাখ
সত্যিই কি দিনের শুরু দেখলেই বলে দেওয়া যায় , বাকি দিনটা কেমন যাবে ?
মিঠুর তখন দশ বছর বয়স । ছটফটে প্রতিশ্রুতিময় স্কুল ছাত্রী । চোখ ভর্তি স্বপ্ন , অনেক অনেক কিছু হওয়ার স্বপ্ন । তিন ভাই বোনের মধ্যে মিঠুই জ্যেষ্ঠ সন্তান । ভাড়া বাড়ির সংসারে বাবা-ই সবকিছু । অনটনের সংসার হলেও, সংসারে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় শান্তি বজায় ছিল । সওদাগরী অফিসের কাজের পরও বাবা অন্যকিছু একটা অতিরিক্ত কাজ করতো , অভাবের চোখ রাঙানি কে ঠেকানোর জন্য । ফলে সপ্তাহের রবিবারটাই মিঠুর কাছে হয়ে উঠত রূপকথার দিন । বাবাকে কাছে পেয়ে মিঠুর নিজেকে সবচাইতে ক্ষমতাশালী বলে মনে হত ।
দিনটা ছিল পয়লা বৈশাখ । না , সেদিন তীব্র গরমের দাবদাহ ছিল না । সারাটা দিন মেঘলা আকাশ এবং থেকে থেকে দমকা বাতাস সকলেরই দেহমনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল । ছবিটা বদলে গেল দুপুরের পর থেকেই । কালো মেঘের ঘনঘটায় দুপুরকেও রাত বলে মনে হচ্ছিল । তীব্র ঝড় আর বৃষ্টির দাপটে আমাদের ভয় হতে লাগলো । ঘরের টালির চালটা মনে হচ্ছে ভেঙে পড়বে । মিঠুর একদম আটপৌরে মা , সব ভাইবোন কে খাটের উপর জড়ো করে কোনো একটা দেবতার নাম বির বির করে স্মরণ করছিল । ওই অবস্থাতেই মা আমাদের যা হোক করে দুপুরের খাওয়া খাইয়ে দিল । মিঠু সকলের বড় । তাই যথেষ্ট সাহসী । তুবড়ে যাওয়া ভাতের হাঁড়ি হাতড়িয়ে মা অল্পকিছু ভাত সংগ্রহ করে নিজের উদরপূর্তি করবার চেষ্টা করছিল । মিঠু সেইদিকেই আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কোনো এক বিপদের আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো । কি জানি , হয়তো দুর্যোগপূর্ণ প্রকৃতি মিঠুর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ।
তখন সন্ধ্যা সাতটা হবে । ঝড়ের দাপট কমলেও , অল্প বৃষ্টি নাগাড়ে পড়েই চলেছে । আশপাশের প্রতিবেশীরা বলছেন , পুরো শহরেই নাকি জল জমে গেছে । কোথাও কোথাও গাছও ভেঙে পড়েছে । আমার শিশুমনের চিন্তাকে থামিয়ে দিল , মায়ের শঙ্খ ধ্বনি। প্রতিদিনের মতো মা সন্ধ্যে দিচ্ছে । হঠাৎই ঘরের বাইরে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম । সাথে সাথেই আমাদের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ । আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ওরা আমার বাবা কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । মনে হলো অচেতন ।
বাবার গুরুতর হার্ট এ্যাটাক হয়েছে । কেউ বোধহয় পাড়ার মুখার্জি ডাক্তার কে ডেকে নিয়ে এল । ভালো ডাক্তার । ডাক্তার বাবু জানালেন বাবা মারা গেছেন ! আমি সবকিছুই বুঝতে পারলাম , কিন্তু আমি এখন কি করব ?
কোন কোন সময়ে মৃত্যু সংবাদের থেকেও বেশি দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে থাকে । ডাক্তার বাবু অনেক টাকা না পেলে বাবার ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন না বলেদিলেন । মা আমাদের জড়িয়ে ধরে সর্বস্ব হারানোর হাহাকার করছে । ঈশ্বর মানুষের কঠিনতম পরীক্ষা নেন এবং পাশেও থাকেন । প্রতিবেশীরাই সবকিছুর বাবস্থা করে দিলেন ।বাবার মরদেহ সময়মতো সৎকারও হয়ে গেল ।
( দ্বাদশ বছর অতিক্রান্ত )
শোকে, দুঃখে এবং দুশ্চিন্তায় বছর খানেক হল মা গত হয়েছেন । দুইটি ছোটো ছোটো ভাইবোনের মা - বাবার ভূমিকায় আমিই অভিনয় করতে লাগলাম । ভাই বোনদের স্কুলে পড়াচ্ছি । বাড়ির কিছুটা দূরেই একটা পাউরুটি কারখানায় প্রতিদিন প্রায় বারো ঘণ্টা পরিশ্রম করি । যা পাই তাতে চলে না । তাই কাজের ফাঁকে পাড়ার সবিতা দিদির টেলারিংয়ের দোকানের থেকে কাজ এনে সেলাই করি । পিছনে ফেলে আসা খারাপ সময়টাকে চিন্তা করার অবকাশ নেই । সামনের দিনে আমাকে কি করতে হবে , সেই চিন্তাতেই দিন কেটে যায় ।
এক সময়ে ভাই বোনেরাও তাদের স্কুলের গণ্ডি পার করলো । ভাই বোন দুজনেই ছোটো খাটো টিউশনি করে নিজেদের খরচ অনেকটাই চালাতে লাগলো । এত দিন বাদে নিজের দিকে তাকানোর ফুরসৎ হলো ।
কখন যে নিজের আঠাশটা বসন্ত পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি । কর্মসূত্রে অনেক মানুষের খারাপ দৃষ্টির মুখে পড়তে হয়েছে । কেউ কেউ আমাকেই খারাপ ভেবে নিয়েছিল । মাথার উপর কোনো অভিভাবক না থাকলে যা হয় আর কি !
বিধাতার ইচ্ছা বা অনিচ্ছাতে আমার বিয়েও হয়ে গেল । স্বামী সিকিউরিটির কাজ করে । শ্বশুর শাশুড়ি থাকলেও , শ্বশুর বাড়ি ছিল না । আমার স্বামী আমাকে নিয়ে আলাদা থাকে । নতুন বই আর নতুন বউয়ের কদর কিছুদিন থাকে বোধহয় । তাই , আমার সংসার ভালই চলছিল । দুজনের রোজগারে সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকলেও অভাব ছিল না । অনেক আশার সংসারে আমার কোলে "আশা"এলো । ফুটফুটে মেয়ে । প্রাণশক্তিতে ভরপুর ।
নুনে পড়া বিস্বাদ খাবারের মতোই আমার "খেলা ঘরের সংসার" হঠাৎই বিস্বাদ হয়ে উঠল। "ভালো মানুষ" আমার স্বামী হঠাৎই মদ্যপান ধরলো ! তারপর পারস্পরিক দোষারোপ , অশ্রদ্ধা প্রকাশ এবং অমানবিকতার অসহনীয় পরিবেশ আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো একদিন ।
আমার একমাত্র প্রাধান্য আমার কন্যা আশা । আমার আশার উপর কোনো খারাপ প্রভাব পড়তে দেবো না , স্থির করে ফেললাম । আমার স্বামীর থেকে দূরে থাকবো এটাই প্রাথমিক কর্তব্য ।
শুরু হলো আমার দ্বিতীয় সংগ্রাম । আমার এবং আমার মেয়ের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই । কিন্তু প্রতিবন্ধক হয়ে উঠলো তীব্র অর্থাভাব । আমার সাহসের অভাব কোন সময়েই ছিল না । কিন্তু সাহস দিয়ে তো অভাব মেটানো সম্ভব নয় , যদি না ঈশ্বরের একটু করুণা না থাকে । টেলারিং এর দোকানের সবিতা দি ঈশ্বরের দূত হয়ে উপস্থিত হল । পাউরুটির কারখানার অল্প রোজগার এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর শরীর নিতে পারছিল না । সবিতা দি সবই জানত । উনি বললেন , মিঠু , আমি তোমাকে কিছু পরামর্শ দিতে চাই । তুমি যদি কিছু মনে না করো , তাহলে মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়ির একটা ঘরে এসে থাকতে পারো । যখন পারবে , ক্ষমতা অনুযায়ী ভাড়া দিও । তা না হলে এই ছোট্ট দুধের বাচ্চা কে নিয়ে বিপদে পড়বে । সবিতা দি'র বলার মধ্যে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হল না ।
এই ভাবেই পাঁচটা বছর কেটে গেল । আশাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে । বুঝতে পারলাম আমার মেয়ে যথেষ্ট মেধাবী এবং বুদ্ধিমতি । কিন্তু মেয়েকে কোনো বোর্ডিং স্কুলে দিতে পারলে ভালো হয় । অনেক চেষ্টা একটা ভালো মিশনারী পরিচালিত স্কুলে অনেক কাঠ খর পুড়িয়ে ভর্তি করে দিলাম । কিন্তু অর্থ যোগান দেওয়ায় ব্যবস্থা দ্রুত সমাধান করতে হবে । আবার সবিতা দি আমার ত্রাতা হয়ে উপস্থিত হলেন । এই অঞ্চলেরই এক প্রৌঢ় অটো চালক তন্ময় বাবুর সঙ্গে সবিতা দি আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন । কারণ আমি অটো চালিয়ে রোজগার করতে ইচ্ছুক ছিলাম । তন্ময় বাবু আমি মহিলা বলে সকাল বেলাটা আমাকে ওনার অটো চালাতে বললেন ।
এই জীবিকা একদমই সহজ ছিল না আমার কাছে । একে তো মহিলা । অনেক খারাপ দৃষ্টি , অপমান সহ্য করে অসম যুদ্ধে সামিল হলাম । কষ্ট হলেও মেয়ের স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো ঘাটতি রাখলাম না ।
ঈশ্বর আমাকে একেবারে নিঃস্ব করলেন না । আমি জানতাম আমার "আশা" খুবই মেধাবী । পুরো পড়াশোনাটাই ওরই স্কলারশিপে এগোতে লাগলো ।
আমার শ্রমসাধ্য পেশা আমার নিত্যকার সঙ্গী । তবে সময়ের সাথে সামাজিক ও পেশাগত বিদ্রুপ এখন যথেষ্ট সম্মানে পরিণত হয়েছে । পেয়েছি অনেক শুভানুধ্যায়ীকে । তাই অমানুষিক শ্রম অব্যাহত থাকলেও , মনে রয়েছে আত্মমর্যাদার শান্তি । আমার স্বামীও ওর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে । আমাকে এক সময়ের নির্মম নির্যাতন ওকে বর্তমানে লজ্জা এবং কষ্ট দেয় , বুঝতে পারি । আমাকে ও এখন শ্রদ্ধা করে । শ্রদ্ধা করে আমার হার না মানা মনোভাব কে , আমার আত্মমর্যাদা কে । আমরা আবার একসাথে সামাজিক জীবন অতিবাহিত করছি ।
আশা আজ আসবে । ওর উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে, সাফল্যের সঙ্গে IAS হয়েছে । একজন সফল আমলা । ঝকঝকে উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক , ছাব্বিশ বছরের সফল যোদ্ধা । কিন্তু আমি কেনো এত আনমনা হয়ে যাচ্ছি আজকে ? হয়ত আজকের মেঘলা আবহাওয়া , আমার দশ বছর বয়সের সব হারানোর যন্ত্রণা কে মনে করিয়ে দিতে চাইছে । আশার বাবাও এই মুহূর্তে ঘরে নেই । বাইরে বেরিয়েছে মেয়েকে স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ায় সামগ্রী কেনাকাটা করতে । আমি নিজের শরীরটাকে ঝাকুনি দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম । উনুনে মেয়ের জন্য পায়েস করছি । আমার হাতের পায়েস আশার বড়ই প্রিয় !
দরজার বাইরে গাড়ির শব্দ পেলাম । একগাল হাসি নিয়ে সবিতা দি , আশার বাবা এবং প্রতিবেশীদের অনেকেই প্রায় রাজকীয় সম্বর্ধনায় আশা কে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল । আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিরঅহংকারী মাটির কাছাকাছি থাকা ভদ্র , নম্র আশা !
বাইরের প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেমেছে । কিন্তু আমার মনে ঝড়ের দাপাদাপি চলছেই । ভাবছি আমি কি সত্যিই সফল ? নাকি মেয়ের সাফল্যে আমি সফল ?
আমার মানসিক অবস্থা আশা বুঝতে পারল । আশা আমাকে বলল , মা , তুমি আমাকে উত্তাল সমুদ্রে ডুবে যেতে না দিয়ে , মায়ের দায়িত্ব পালন করেছো । তাই আজ আমি এখানে । এই সাফল্যের কোনোটাই আমার নয় । সবকিছুই তোমার । আমি শুধুমাত্র তোমার আয়না । আমার মধ্যে দিয়ে দুনিয়ার সকলে তোমার সাফল্য দেখছে । আমি তোমাকে পরাধীন করার সাহস দেখাব না । তুমি যেমন স্বাধীন আছ , স্বাবলম্বী আছ তাই থাকবে । শুধু তুমি আমাকে আদেশ করো , আমি কি ভাবে তোমার পাশে , তোমার উপযুক্ত হয়ে থাকব !
ঠিকই তো , আশা একদম ঠিক বলেছে । আমি আমারই উপযুক্ত হব । বহু বছর আগের , সেই , সব শেষ হয়ে যাওয়ার দিনটাও তো ছিল পয়লা বৈশাখ । সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের নিজস্ব উৎসবের দিন । আমি সেইদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , এই দুঃখের পয়লা বৈশাখকেই আমি চূড়ান্ত আনন্দের পয়লা বৈশাখে রূপান্তরিত করবই করব ! আজ সেই প্রতিজ্ঞা কে বাস্তবায়িত করার দিন । দুঃখ কে আঁকড়ে থাকলে , আজকের এই আনন্দ কে খুঁজে পেতাম না । পরম কল্যাণময় ঈশ্বর সব সময়েই সাহসীদের পাশে থাকে । আমি তো সেই সাহসিনী যোদ্ধা l