মাছের ল্যাজা
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই রেখা দেখে, বিছানার আরেকপাশে রোহিত নেই। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমে খোঁজে বাথরুমে, তারপরে যায় বারান্দায়। তারপরে ওপরে গিয়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরের দরজায় টোকা দেয়, দরজা খুলে শাশুড়ি কনকলতা দেবী বলেন, "কিছু বলবি? সবে তো এখন সকাল সাতটা। আজ তো সকলের ছুটি। এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলি কেন?"
"উঠতাম না মা, যদি না তোমার ছেলেকে পাশে পেতাম। এত সকাল বেলা কোথায় গেছে তুমি কি কিছু জানো?"- প্রতিউত্তরে বলে রেখা।
"ওমা, আমি কি করে জানব বল। আমাকে তো তুই এইমাত্র ডেকে তুললি। আচ্ছা ঠিক আছে, যা গিয়ে ওকে একটা ফোন করে দেখ, যদি ফোনটা ধরে তাহলে জিজ্ঞেস করে নিবি।"- রেখাকে এই কথাগুলি বলে কনকলতা দেবী পা বাড়ায় বাথরুমের দিকে।
অন্যদিকে রেখা ঘরে গিয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে রোহিতকে ফোন করতে গিয়ে দেখে রোহিত নিজের ফোনটা রেখে চলে গেছে। কেন জানিনা এবার একটু চিন্তায় পড়ে যায় রেখা।
এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রেখা চিৎকার করে শাশুড়িকে বলে, "মা তোমার ছেলে কিন্তু ফোন রেখে বেরিয়েছে। বাবাকে একটু বলবে কোথায় গেছে দেখার জন্য।"
কনকলতা দেবী বলেন, এত চিন্তা করিস না। হয়তো সামনের পার্কে হাঁটতে গেছে। ফিরে আসবে এক্ষুনি।
আমি চায়ের জল বসাচ্ছি। তুই যা ফ্রেশ হয়ে আয়, সাথে বাবা কেও তুলে দিস।
টেবিলে চা নিয়ে তিনজনে বসে। আস্তে করে কলিংবেলের আওয়াজ, চা টা রেখেই রেখা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। দেখতে পায় রোহিত পুরো ঘেমে হাতে বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে গিয়ে রেখা জড়িয়ে ধরে রোহিতকে। বলে, হঠাৎ করে আমাকে না জানিয়ে কোথায় চলে গেছিলে তুমি?
রোহিত ইতস্তত বোধ করে, কারণ সামনেই বসে আছে তার বাবা মা। শুধু বলে চলো চা খেতে খেতে সবটা বলবো।
ফ্রেশ হয়ে চা নিয়ে বসে রোহিত সবার উদ্দেশ্যে বলে, আজকে রান্না ঘরে তোমরা কেউ যাবে না। আজ তোমাদের ছুটি। আজ আমি তোমাদের জন্য রান্না করবো।
অবাক দৃষ্টিতে সকলে রোহিতের দিকে তাকায়।
রোহিত বলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি রান্না জানি না ঠিকই, তবে মাকে বহু সময় দেখেছি কিভাবে রান্না করে মা। তাই নুন ঝাল মিষ্টি ঠিক না হলেও আজকে আমার হাতের রান্নায় তোমাদের খেতে হবে।
দুপুরে খাবার টেবিলে সবাইকে রোহিত বসতে বলে। আজকে নিজের হাতে পরিবেশন করবে সবার জন্য।
কেন জানিনা সকলের বড্ড অবাক লাগে রোহিতের আজকের কাজকর্ম। তাও কেউ কিছুই বলে না। কেউ জানেই না রোহিত আজকে রান্না ঘরে কি রান্না করেছে সবার জন্য।
প্রতিটা ঢাকা যখন রোহিত খোলে তখন সকলে ভীষণ অবাক হয়ে যায়। ইলিশ মাছের চার রকমের পদ রান্না করেছে রোহিত আজ সবার জন্য।
সবার আগে রোহিত মায়ের পাতে ডিম ভরা সর্ষে ইলিশ তুলে দেয়। মা মানা করা সত্ত্বেও রোহিত বলে ছোটবেলা থেকেই তোমাকে দেখেছি সবাইকে সব সময় ভালো আর বড় জিনিসটা খাওয়াতে। শেষ পাতে পড়ে থাকতো তোমার জন্য শুধুই ল্যাজা টুকু।
তাই সেদিন ঠিক করেই নিয়েছিলাম যেদিন প্রথম মাইনে পাব সেই টাকা দিয়ে ইলিশ মাছ কিনে এনে সবথেকে বড় পিসটা তোমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবো।
মুখ বুঝে সকলকে সুখ দিয়ে নিজে কষ্টটুকু উপভোগ করেছ চিরকাল। আর যে তোমাকে কোন কষ্ট করতে দেব না মা।
আজ "পয়লা বৈশাখ"।
ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে বাবা কখনো সেই ভাবে মাছ এনে আমাদের খাওয়াতে পারেননি কারণ পরিবারটা ছিল বিশাল বড় আর আমার বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে এক মানুষ। বাবার ভেতরে যে কষ্টটা হতো সেটা আজ বড় হয়ে অনুভব করতে পারি। তোমাদের দুজনকে দেখেছি চিরকাল লুকিয়ে এসেছো কষ্টটা। যাতে আমি পুরো সুখটা ভোগ করে বড় হতে পারি।
তিন দিন আগে হয়েছে প্রথম মাসের মাইনে। রেখা জিজ্ঞেস করেছিল- "তোমার স্যালারি হবে কবে?"
আমি বলেছিলাম পয়লা বৈশাখের পরে।
মিথ্যে বলেছিলাম, কেন জানো- তোমাদের চোখে খুশির এই জলটা দেখার জন্য। এসো মা, ছোটবেলায় তো তুমি বহুবার আমাকে খাইয়ে দিয়েছো। আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো, তুমি খাবে।
এই বলে রোহিত এক গরস ভাত মায়ের মুখে তুলে দেয়। তিনজনের চোখ দিয়েই পড়তে থাকে খুশির জল।
"পহেলা বৈশাখে এর থেকে পরম পাওয়া কনকলতা দেবীর আজ পর্যন্ত হয়নি"।
মনে মনে বললেন, আমি তোকে মানুষ করতে পেরেছি, এটা আমার অনেক বড় পাওনা, ভালো থাকিস বাবা।