ছোটগল্প - নতুন নিয়ম
-- হ্যাগো শুনছো! জামাইবরণের সময় দেখলাম, জামাইয়ের মা ও এসেছেন! কি অলক্ষুণের কান্ড বলো?
-- এতে তুমি কি অলক্ষুণের কান্ড দেখছো অন্তরা?
- এটা তুমি কি বলছো! কোনদিনও শুনেছো ছেলের বিয়েতে মা এসেছেন ছেলের বিয়ে দেখতে। এ নিয়ে আত্মীয়-স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীরাও আলোচনা করছেন। ছিঃ! ছিঃ! কি লজ্জার বিষয়; তোমার আরড়ও একটু খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।
- আজকাল এই পুরোনো নিয়ম কেউ মানে না বুঝলে। নিয়ম মানুষেই বানায়, আর খোঁজখবর নেওয়ার কথা বলছো আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি, আর ভালো করে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে দেবো তুমি ভাবলে কি করে? প্রত্যেকে বলেছেন শৈবালের মা বাবার তুলনা হয় না। একমাত্র ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করেছেন। শিক্ষিত পরিবার। আমাদের মলি খুব সুখে থাকবে দেখো। লোকজনের কথায় কান দিও না ওরা দুদিন বলবে তিনদিন বলবে চারদিনের দিনে চুপ হয়ে যাবে। আমাদের মেয়ে সুখী আছে না অসুখী আছে দেখতেও আসবে না।
-- জানিনা বাবা যতোসব অলক্ষুণে কান্ড। সবসময় জেনে এসেছি ছেলের মাকে মেয়ের, মাকে কখনও বিয়ে দেখতে নেই।
-- অন্তরা একটু আধুনিক হও। যুগ পাল্টাছে। যুগের সাথে নিজেকেও পাল্টাও।
-- এত আধুনিক আমি হতে পারছি না তুমি হও!
এত আধুনিক.... বলতে বলতে বেড়িয়ে যান অন্তরা দেবী।
অন্তরা দেবীর কথা শুনে হাসতে থাকেন রথীন্দ্র বাবু মলির বাবা।
আজ রথীন্দ্র বাবু আর অন্তরা দেবীর একমাত্র মেয়ে মল্লিকার বিয়ে অমল বাবু আর বাণী দেবীর একমাত্র ছেলে শৈবালের সাথে। দুই বাড়ি থেকে নববর্ষের দিন বিয়ের ডেট ফাইনাল করে কিন্তু এখানে এক কান্ড ঘটে গেছে ছেলের মা স্বয়ং হাজির ছেলের বিয়েতে। আত্মীয়-স্বজন অনেকেই বারণ করেছিলেন বিয়েতে না যাওয়ার জন্য কিন্তু সবাইকে বাণী দেবী বলেন "আমার থেকে বেশি আমার ছেলের কেউ ভালো চাইতে পারে না, যে ছেলেকে এতো কষ্ট করে জন্ম দিয়েছি সেই ছেলের এই বিশেষ দিনে আমি থাকবো না তাই হয় নাকি? আমি যাবো আমার ছেলের বিয়েতে এবং বিয়েও দেখবো"। বাণী দেবীর এই কথাতে অমল বাবু আর শৈবালও একমত থাকেন তাই সামনাসামনি কেউ আর কিছু বলতে পারেন না। বিয়ে গোধূলি লগ্নে হওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি সব মিটে যায়। খাওয়াদাওয়ার পর্ব মিটে যাওয়ার পর বরযাত্রীর লোকেরা যখন বিদায় নেন রওনা দেবার জন্য তখন বাণী দেবী সবার সামনে মলিকে বলেন "নতুন বছর পড়তেই আমার বাড়ির মা লক্ষ্মী পা দেবে। কাল তোর আসার অপেক্ষায় থাকলাম। একদম মন খারাপ করবি না। আজ থেকে তোর দুটো বাড়ি হল। এই বাড়িতে যেমন তুই থাকিস ওই বাড়িতেও ঠিক তেমনই থাকবি। আর বেয়ান আপনাকে বলছি কাল মলিরা যখন রওনা দেবে তার আগে কনকাঞ্জলী যেন না হয়। আমাদের বাড়ির কেউ এইগুলো বিশ্বাস করে না।
কথাটা শুনে অন্তরা দেবী বলেন "এ কী বলছেন বেয়ান কনকাঞ্জলী একটা নিয়ম। এই নিয়ম না মানলে অমঙ্গল হবে"।
"আপনি বলুন তো বেয়ান দুমুঠো চাল দিয়ে মলি আপনাদের ঋন শোধ করতে পারবে কখনো? আপনারা ওকে যে এত বড় করেছেন, ওর শরীর খারাপ হলে আপনারা রাত জেগে ওকে সুস্থ করেছেন, পড়াশোনা করিয়েছেন এইগুলো কি চাল দিয়ে শোধ হয়? আপনি নিজেও তো একজন মেয়ে আপনাকে যখন এই নিয়ম পালন করতে বলা হয়েছিলো যখন বলেছিলেন, 'মা তোমার সব ঋণ শোধ করলাম'। আপনার মনে কি অবস্থা হয়েছিল আর আপনার মায়ের মনে কি অবস্থা হয়েছিল"? মনে আছে?
"কিন্তু বেয়ান লোকে কি বলবে"?
"একটু লোকের কথা বাদ দিই না। একজনকে তো নিয়ম ভাঙতেই হবে। এই নতুন বছরে নতুন নিয়ম না হয় আমি আর আপনিই শুরু করি"!
"কি অন্তরা এবার কি বলবে" রথীন্দ্র বাবু বলেন"।
"বেয়ান বিয়ে দিয়ে দিলে কি মেয়েরা পর হয়ে যায়, মেয়ের উপর কোনো অধিকার থাকে না?এই কনকাঞ্জলী, ছেলে মেয়ের বিয়ে মা দেখতে পারবেন না এইসব নিয়ম আমরা এবার ভাঙি চলুন না নতুন বছর থেকে" অমল বাবু বলেন!
"অন্তরা আমি আমাদের মেয়ের জন্য ভালো শ্বশুরবাড়িই দেখেছি। এবারও তুমি বলবে আমাদের মেয়ের অমঙ্গল হবে। এইরকম মা বাবা পাচ্ছে আর আমাদের কোনো চিন্তা নেই। ওনারাই সামলে রাখবেন আমাদের মলিকে।
সব কথা শুনে অন্তরা দেবী বলেন "আমায় ক্ষমা করে দেবেন বেয়ান। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। আপনার বিয়েতে আসা নিয়েও আমি অনেক কথা বলেছি। আপনি ঠিকই বলেছেন একজনকে নিয়ম ভাঙতেই হয়। এই নতুন বছরে না হয় আমরাই পুরোনো নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়মে চলি।