মিষ্টিমুখ
ধানবাদের কয়লা খনি অঞ্চলে জ্বালানি গবেষণাগারের খুব কাছে ছোট্ট সংসার অংশু ও অনিন্দিতার। বিয়ের ছ'মাসের মধ্যে কলকাতা থেকেই বদলি হয়ে অংশু ধানবাদে। অনিন্দিতা তার নতুন সংসারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিজের স্কুল শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে ধানবাদে গিয়ে থাকতে শুরু করলো।। বছর দুই যেতে না যেতে সন্তান এলো। ছেলের নাম রাখা হল নীল।
অনিন্দিতার ধানবাদ যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকে অংশু তার ইন্সটিটিউটের দারোয়ান রাম লালের বৌকে বাড়ির কাজে নিয়োগ করলো রামলালেরই ইচ্ছে তে। অংশু সারাদিন ব্যস্ত থাকে কাজে। অনিন্দিতা একা বাড়িতে সংসার সামলায় আর বই পড়ে আর ছোটবেলায় শেখা গানের খাতা উল্টে পাল্টে গান করে।
কিছুদিন পর রামলালের বৌ বিনতিও অন্তঃসত্ত্বা হল। নীল জন্মানোর পাঁচ মাস পর বিনতির কোল আলো করে এলো মেয়ে। বিনতির সে কি কান্না। অনিন্দিতা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে, আদর করে তার নাম রাখলো মৈথিলী। দিন মাস বছর দ্রুত কাটতে লাগলো। এক এক করে বছর যেতে লাগলো।
অনিন্দিতা রামলালকে বললো, 'রামভাই মেয়েকে কিন্তু স্কুলে পাঠাতে হবে, পড়াতে হবে। আমার ছেলে পড়বে আর তোমার মেয়ে ঘরে ডাল রুটি বানাবে তার হবে না'।
রামলাল আপত্তি করেনা। অংশু ও অনিন্দিতাকে সে যথেষ্ঠ সম্মান করে।
তিনবছরের হলে নীল ভর্তি হল ধানবাদের সবচেয়ে বড় ছেলেদের স্কুলে। মৈথিলীকে অনিন্দিতার ইচ্ছেতে ভর্তি করা হল ধানবাদের একটি মেয়েদের খ্রীষ্টান স্কুলে।
সন্ধেবেলা অনিন্দিতা দুইজনকে নিয়ে বসে অক্ষর পরিচয় করিয়েছে। নিরক্ষর বিনতি আর শুধু সই করতে জানা রামলাল কীভাবেই বা পড়ালেখা শেখাবে মৈথিলীকে।
ক্রমশই বোঝা গেল মৈথিলী পড়ালেখায় একটু ভালো না, বেশ ভালো। ওর নেওয়ার ক্ষমতা, আই কিউ একই বয়সী অনেকের চেয়ে অনেক বেশি।
মাঝে মাঝে অনিন্দিতা ভাবে যে ঘি ব্রাহ্মী তো অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দুজনেই খেয়েছে। কিন্তু ছেলেটা তো এতো বুদ্ধি ধরেনা। মেয়েটা কেমন করে এতো ঝলমলে হল! চকচকে চোখ, ইষৎ মলিন বরণ, মাথা ভরা চুল। মেয়েটা যেন ওর যে ঘরে জন্ম তার চেয়ে পুরোই আলাদা। আচার আচরণে, পড়ালেখায়, সবকিছুতে।
ভালো মনেই বিনতির মেয়ের জন্য এতকিছু করেছে অনিন্দিতা কিন্ত নিজের একমাত্র সন্তানের থেকে তার যে এই বৈষম্য এ যেন পীড়া দেয় অনিন্দিতা কে। ছেলেটাও যদি এমনই হতো! নীল পড়ালেখায় একদম সাধারণ, মা বাবার মতো অধ্যাবসায়ও তেমনটা নেই। সে ভালোবাসে খেলতে। ভালোবাসে ছবি আঁকতে।
দেখতে দেখতে দুজনেরই দশ ক্লাসের পরীক্ষার সময় এসে গেল। অংশু রামলালকে কিছু টাকা দিয়ে বললো 'মেয়েকে ভালো করে খেতে দিস। সামনে পরীক্ষা যত্ন করিস'। রাতে অনিন্দিতাকে কথাটা বলতে সে প্রচণ্ড রেগে গেল। অংশু বুঝতেই পারলো কী হয়েছে ওর! যে মৈথিলী কে এতো ভালোবেসেছে জন্ম থেকে, যে নিজের সন্তান আর কাজের লোকের সন্তানের সঙ্গে জীবনে কোনদিন পার্থক্য করেনি একি আচরণ তার? বুঝতে পারেনা অংশু।
অনিন্দিতা অংশুকে এও বললো যে রামলাল এখন মন্দ মাইনে পায়না। বিনতিও একাই এ সংসার দেখাশোনা করে এসেছে অনেকদিন ধরে। তাই তার মাইনেও নিতান্ত কম না। দুজনের রোজগারে ওদের পরিবার স্বচ্ছল। সেখানে পরীক্ষার জন্য আলাদা করে টাকা দেওয়ার কিছু হয়নি।
'এরপর থেকে তুমি পড়ালেখা বাবদ আর কিছু দেবেনা। মৈথিলী ওর স্কুলের টিচারদের থেকে অনেক সাহায্য পায়, স্কুল নিখরচায় পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওর মেধা আছে বলে সেখানে তুমি কেন আরো দেবে?'
ভারি বিশ্রী লাগে অংশুর। কিন্তু গায়ে ভদ্রলোকের রক্ত থাকলে বৌ এর সঙ্গে বিবাদে এক জায়গায় থেমে যেতে হয়। না হলে মাথা নীচু হবেই। তাই সে আর কিছু বলেনা।
যথারীতি দশ ক্লাসের ফল বেরলে দেখা গেল মৈথিলীর নাম দেশের প্রথম দশ জনের মেধা তালিকায় আছে। আর নীল মৈথিলীর নম্বরের চেয়ে দশ শতাংশ পিছনে। খবর পেয়ে অনিন্দিতা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
নীল বাড়ি ফিরে ডাকাডাকি করলো 'মা, দরজা খোলো। '
মৈথিলী কে সঙ্গে করে বিনতি এসে ডাকলো 'ভাবি দরয়াজা খোল দিজিয়ে' ।
অনিন্দিতা চুপ। তার ইচ্ছে মতো সে দরজা খুলবে বন্ধ করবে যা ইচ্ছে করবে। তার ইচ্ছেতেই বিনতির মেয়ে পড়ালেখা শিখেছে বড় স্কুলে। তার ইচ্ছেতেই আট বছর পর রামলালের যে ছেলে হয়েছে তার পড়ালেখার দায়িত্ব কেউ নেয়নি। সে নিজে জানতো না তার নিজের ইচ্ছে তার কাছেই জ্বালা হয়ে ফিরে আসবে।
অনিন্দিতা বোঝেনি শুরু করার সময় শেষের কথাটা আড়ালে আবডালে রেখে হলেও ভেবে নিতে হয়, ধর্তব্যের খাতে রাখতে হয়। না হলে সৎ বাস্তববাদী মানুষের মতো সব সত্যকে সাগ্রহে গ্রহণ করার মনুষ্যত্ব বোধ নিয়েই চলতে হয়। এর মাঝামাঝি কিছু হয়না। নীলের ছবি আঁকার মধ্যে যে প্রতিভা আছে তা হয়তো মৈথিলীর অঙ্ক ও বিজ্ঞানের মেধাকে ছাপিয়ে যাবে ভবিষ্যতে। বলা কি যায়? অনিন্দিতার এসব যুক্তি খুব দুর্বল লাগে। তার কাছে এটাই একমাত্র সত্য তার ছেলে অষ্ট আশি শতাংশ পেয়েছে আর বিনতির মেয়ে পেয়েছে আটানব্বই শতাংশের সামান্য বেশি।
রাত্তিরে রুটি বানাতে আসার সময় বিনতি বাড়ির বানানো ক্ষীর আর মিষ্টি নিয়ে এলো । তার প্রিয় ভাবি, সাহাব আর নীল বেটার জন্য নিয়ে এসেছে।
অনিন্দিতা হাত পেতে নিতে পারলো না। বললো 'টেবিলে রাখ।'
বিনতি রাতের রান্না সেরে টেবিল সাজিয়ে চলে গেল। নীল খাওয়ার পরে সবে ক্ষীর নিতে গেছে, অনিন্দিতা ক্ষীরের বাটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো। নীল পরীক্ষায় খারাপ করেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে আরো ভালো করার উৎসাহ সে মায়ের কাছ থেকে পেল না। মা বুঝলো না ছেলের মনে এর প্রভাব কেমন হতে পারে। মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তার ছেলের নম্বর কম আর তার পরিচারিকার মেয়ের প্রাপ্ত নম্বর বেশি।
অনিন্দিতার কাছে ছেলের মুখের গ্রাস ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কিন্তু ছেলের সামান্য পিছনে থাকা কে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেনা মন। কেন মানতে পারল না অনিন্দিতা? এ কি তবে তার স্বভাবের দ্বিচারিতা? নাকি অন্ধ মাতৃত্ব বোধ। আমার জঠর জাত সন্তানকে সবার আগে দেখতে চাওয়ার অন্ধ মোহ। বিকৃত আপন পর বোধ যা সেই প্রবাদ সৃষ্টি করেছিল পরের ধন পরমানন্দ? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো মনোবিদের কাছে আছে কি?