Logo
logo

গল্প / কাহিনী

ছোটগল্প - যা হারিয়ে যায়

আজ সকাল থেকেই মাথা ধরে আছে দীপুর। দীপু হল দৃপ্ত দত্ত। কলকাতার এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী। একটু লাজুক প্রকৃতির, বিয়ে করেনি,শখ বলতে ঘুরতে যাওয়া,বই পড়া আর গান শোনা। কোন নেশা নেই, তবে ব্ল্যাককফি পছন্দ করে। আজ গা-টাও যেন কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে, জ্বর জ্বর ভাব। অফিসে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু দীপু খুব একটা অফিস কামাই করে না। বাড়িতে বসে থাকতে মোটেই পারে না সে। রোজকার মতন ব্ল্যাককফি নিয়ে ব্যালকনিতে, খবরের কাগজের পাতা উল্টোছিলো সে। কফিটা শেষ করেই স্নানে যাবে।
তার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকেই সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা চোখে পড়ে দীপুর। এই দু-কামরার ফ্ল্যাটে সে বছর তিনেক হল এসেছে । ছিম ছাম দক্ষিণ খোলা, বেশ লাগে তার।

স্নান করে দুধ কর্ণফ্লেক্স খেয়ে অফিসের জন্য বেরোতে যাবে ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে পলাশ বলল ---- " মনে আছে তো আজ সন্ধ্যো সাতটায় আমাদের বাড়িতে চলে আসিস,আমি কিন্তু পরমকেও বলে দিয়েছি। তুই শুধু আসার সময় মৌ-কে ওর অফিস থেকে তুলে নিস। ফোনটা রেখে দীপু ভাবলো,সে তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। আজ ওদের রেস্তোরাঁর ব্যাপারে আলোচনা আছে । যেটা নববর্ষের দিনেই ওপেনিং । নামটা ওই সাজেস্ট করেছে,--- "স্বাদে গন্ধে"।
অফিসে এসে প্রতিদিনের মতো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল দৃপ্ত। টিফিন টাইম হয়ে গেছে। বিমল একবার হাঁক দিল --- " ওহে আজ কি হয়েছে? খাবে না? দৃপ্ত হেসে বলল -- হ্যাঁ খাবো। ওর অফিসের ঠিক সামনেই একটা ক্যাফে আছে । সেখানে গিয়ে মাঝেমধ্যে কফি খেয়ে আসে দৃপ্ত। আজ যেহেতু শরীরটা বশে নেই আর কাজের চাপও ভয়ানক নয় তাই সে আজ সামনের ক্যাফে তে যাবে বলে যেই চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে ঠিক তখনই একজনকে দেখে চেয়ারে বসে পড়ল।

মনে পড়ে যেতে লাগলো কত কথা। দশ বছর আগের সব কথা। দীপুর ছোটবেলা কেটেছে সুভাষ গ্ৰামে। গ্ৰাম দেশ প্রচুর সবুজ কত ফুল --ফল ,পাখ - পাখালি, পুকুর - ডুব সাঁতার , খেলাধুলা - এসবের মধ্যে দিব্বি কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু এক নববর্ষের দিনে ওদের পাড়ায় এসেছিল মিলি। দীপুর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মহিলা ওর মা। আর তারপর এই মিলিকে দেখেই ওর মনটা কেমন যেন করে উঠেছিল। মিলিরা ছিল খুব বড়লোক।ওর বাবা ছিলো বড় ব্যাবসায়ী। ওরা এই পাড়ায় আসার পর থেকেই মিলিদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। এর আগে ওদের পাড়ায় পুজো বলতে ছিল - সরস্বতী পুজো।
দুর্গা পুজো হত বেশ খানিকটা দূরে মিলনী সংঘের মাঠে।
মিলিদের বাড়িতে নববর্ষের দিনে পুরো পাড়ার নেমতন্ন থাকতো। সেই দিন সবাই নতুন জামা পড়ে ওদের বাড়ি যেতে। বছরের এই দিনটা সরস্বতী পুজোর দিন, আর দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন -- মিলির দেখা পাওয়া যেত। ওর কাছে যেতে পারত দীপু।
সেই বার মনে আছে নববর্ষের দিন দীপু মিলিকে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে দীপু কতবার যে হাত বুলিয়ে ছিল , কিন্তু দেওয়া হয়নি সেই চিঠি। খবর টা এল সকাল ন ' টা নাগাদ দীপুর মা সামনের পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ডুবে গেছে। দীপুর পৃথিবীটা যেন দুলে গিয়েছিল সেই দিন। সারাদিন কিচ্ছুটি খাইনি সে। একা ঘরে বসে খুব কেঁদেছিলো । মাকে দেখতেও বেরোয়নি সে। পরের দিন ওর মাসি এসে দীপুকে নিয়ে কলকাতার গড়িয়া অঞ্চলে চলে আসে নিজের কাছে। এখানেই মানুষ হয়েছে দীপু ওর মাসির কাছে। দীপুর বাবা আবার বিয়ে করেছে। ওর জন্য মাসির কাছে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতো। কিন্তু ওকে দেখতে একদিনের জন্যেও আসেনি।

এক নিমেষে দীপুর জীবনটা অনেকখানি বদলে গিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ মা আর মিলিও হারিয়ে গিয়েছিল সেই নববর্ষের দিনে। আজ এতদিন পর হঠাৎ মিলিকে দেখে দীপুর মনটা আবার কেমন যেন করে উঠল। মিলিও দীপুকে দেখে একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। তারপর ব্যাঙ্কের কাজ শেষ হলে দীপুর প্রথম কথা বলেছিল -- কেমন আছো? কোথায় থাকো? কি করো? মিলি বলে -- সব কথা কি এখানেই বলবে? ওরা দুজনে সামনের ক্যাফেটাতে গিয়ে বসে। আর সপ্তাহ খানেক পরেই নববর্ষ। ক্যাফেটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে আজ। দীপুর কেমন যেন মনে হল মিলি আসবে বলেই এমন সাজো সাজো রব। মিলি কে দেখছিল দীপু দু'চোখ ভরে। এখনও কি সুন্দর, দুপুরের রোদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেতে বসে অনেক কথা ভীড় করে আসছিল দীপুর মনে। হঠাৎ - ই এক যুবক বয়স একুশ,বাইশ হবে একটা পেন আর কাগজ মিলির সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল -- একটা অটোগ্রাফ প্লিজ। মিলি অটোগ্রাফ দিয়েই দীপুকে বলল আজ উঠি একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আছে । আর কথা না বাড়িয়ে সানগ্লাসটা পরে মিলি ওর ভিজিটিং কার্ডটা দীপুকে দিয়ে বেরিয়ে গেল। দীপু দেখল -- তাতে লেখা অনিতা বসু। সে এখন নামকরা পেইন্টার। দীপু তার মোবাইলে গুগুলে সার্চ করে দেখলো বেশ নাম করেছে মিলি। কিন্তু সে যেহেতু এই জগতের কিছুই খোঁজ খবর রাখে না তাই চিনতে পারেনি। আপন মনেই -- দীপু বলল মানুষ কতটুকুই বা চিনতে পারে নিজেকে! যে অন্য কাউকে চিনতে পারবে।
আজ নববর্ষ। আকাশ মেঘলা মনে হয় দু - এক পশলা বৃষ্টি হবে। দীপুর মনটাও সিক্ত। সকালে উঠে গরম কফি তে চুমুক দিয়ে মিলির চোখ দুটো মনে পড়ল দীপুর , উজ্জ্বল- গভীর। মোবাইলে নোটিফিকেশন এল একটা --

আজ বিকেলে একাডেমিতে আমার সোলো এক্সিবিশান আছে ,পারলে এসো। দীপু মোবাইলটা পাশে রেখে গান ধরল -- " আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে"।
বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে। উল্টোদিকের কৃষ্ণচূড়া গাছটা এখন লালে-- লাল, বৃষ্টিতে ভিজছে।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com