ছোট গল্প - ঝড়ের সাথী
আজও সেই দিনটার কথা মনে পড়ে সায়ন্যার ।
তাদের দেখা হয়েছিল শরতের এক সোনাঝরা রোদের সকালে, বাসস্ট্যান্ডে। প্রথমে মৌখিক আলাপ, তারপরে বন্ধুত্ব। অবশেষে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে হতে এক বসন্তের বিকেলে অস্তগামী সুর্যকে সাক্ষী রেখে দুজনে শপথ নিয়েছিলো জীবনের বাকিটা পথ তারা দুজনে একসাথে পা মিলিয়ে হাঁটবে। ওরা দুজন মানে সায়ন্যা আর অগ্নিভ।
তারও একবছর পর দুই বাড়ির অনুমতি, ক্রমে এক ফাগুন সন্ধ্যায় সানাই এর সুরে, রজনীগন্ধার মিষ্টি সৌরভে অগ্নিসাক্ষী করে সাতপাকে ঘুরে শুরু হল তাদের নতুন জীবনের পথচলা।
শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার কিছুদিন পরে এল বাংলা নববর্ষ, পয়লা বৈশাখ। রক্ষনশীল মুখার্জী পরিবারের মেয়ে সায়ন্যা। ছোট থেকেই বাড়ির বড়দের সাথে পূজার্চনা ,নৈবেদ্য সাজানো আলপনা দেওয়া সব কাজ হাতে হাতে করতেই কাটতো পয়লা বৈশাখের সকাল। কিন্তু এখানে তো পূজোপাঠের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল সায়ন্যার।
হঠাৎ কানে এল কে যেন সুন্দর ভাবে আবৃত্তি করছে সেই সুন্দর কবিতাটি- "আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রানের পর"। বাইরে বেরিয়ে দেখে আপাত গম্ভীর শিক্ষিকা তার শাশুড়ি মাকে। সকালে জলখাবার এর পর আরও কিছুক্ষণ চলল তার এই কবিতা পাঠের আসর।তার সঙ্গে গলা মেলালো তার দুই পুত্র। অগ্নিভ ও তার ভাই নীলাভ।
দুপুরে বাঙালিয়ানা সঙ্গে রেখে জমিয়ে চললো খাওয়া দাওয়া। আর তখনই ঠিক হল সবাই মিলে আজ দক্ষিনেশ্বরে যাওয়া হবে। বছরের প্রথম দিন অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে মায়ের পূজো দেওয়া হল। সবাই মিলে ঠিক করলাম কচুরি খাবো। কচুরির দোকানের দিকে এগোতে এগোতে আকাশ কালো করে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে ধেয়ে এল কালবৈশাখী। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার। ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। তখন অত মানুষ সবাই ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । শাড়িতে অনভ্যস্ত সায়ন্যা দলছুট হয়ে পড়লো। আধো অন্ধকারে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারোর হাতেই মুঠোফোন নেই। মন্দিরে প্রবেশের আগে সেটাও তো জমা দিতে হয়েছে।
নিরুপায় হয়ে সায়ন্যা মন্দিরের দিকেই হাঁটতে শুরু করল। যদি কোন ভাবে ঘোষণা করে অগ্নিভ দের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়। নিজেকে তার আজ বড় অসহায় মনে হল।
এমন সময় আধো অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে কে যেন পিছন থেকে এসে তার হাতটি ধরল। ভয়ে চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই দেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রিয় মানুষটি, অগ্নিভ। উত্তেজনায়, হারিয়ে খুঁজে পাবার আনন্দে দুজনেই তখন বাকরুদ্ধ।
একটু ধাতস্থ হয়ে সায়ন্যা নিজেই বলে উঠলো -- "তোমারই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা / এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথহারা"।