সম্পাদকের মননে
" নববর্ষ ও বাঙালিয়ানা " - লেখিকা : মহুয়া ঘোষ'বাঙালিয়ানা' শব্দটাতে একটা নিবিড় ভালবাসার ওম তথা উষ্ণতা লুকিয়ে আছে যে ভালবাসার উষ্ণতা সারা বিশ্বের সমস্ত বাঙালির বুকের মধ্যেই নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে । চৈত্রের শেষে যখন বসন্ত ক্রমাগত কানের কাছে কুহু কুহু করে কোকিল হয়ে তার বিদায়ের সুর শোনাতে থাকে, তখনই মনে আসে নতুন বছরের আগমনের সুপ্ত বার্তা।
আজকের প্রজন্ম কর্মসূত্রে বাংলা তথা দেশের বাইরে থাকতে বাধ্য হলেও বাংলার প্রতি তাদের নাড়ির টান কিন্তু এই দিনটি এলেই বিশেষ ভাবে অনুভূত হয়। তাই,আজকের জিন্স - টপস্ পরিহিতা সুসজ্জিতা তরুণীরাও ওয়ারড্রবের শেল্ফ থেকে তাদের স্মার্ট ড্রেসগুলোকে আলতো হাতে সরিয়ে শাড়িতেই নিজেকে বিশেষ রূপে সাজিয়ে তুলতে পছন্দ করে।
কিন্তু কেন? আজকের আধুনিকা নারীরাও এইদিনটিতে শাড়ির মত একটা বারো তেরো হাত অস্বচ্ছন্দ পোষাককে কেন বেছে নেয় যেখানে লং স্কার্ট, মিনি স্কার্ট বা গাউনে নিজেকে আরও স্মার্ট করে প্রেজেন্ট করে বছরের বাকি দিনগুলোতে! তার উত্তরেও সেই বাঙালিয়ানার বীজ লুকোনো আছে। প্রতিটি বাঙালি মেয়ের কাছেই নববর্ষ মানে মায়ের মত নিজেকে আবিষ্কার করা তার সামনের আয়নার প্রতিবিম্বে।
আর উৎসবের আরেকটা বড় অংশ হল খাওয়াদাওয়া যা বাংলা ও বাঙালির একটা পরিচয়। সারা বিশ্বে এমন কোন বাঙালি বাড়ি নেই যারা ভোজনরসিক নয়। বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন তার রান্নার মুন্সিয়ানায় সে বাকি বিশ্বের মানুষদের কব্জা করে ফেলবেই। তাই হয়ত কলকাতার বুকে বাঙালি রেস্তোরাঁর নামের হোর্ডিংয়ে এবং মেনু কার্ডেও বাঙালিয়ানার ছাপ ফুটে ওঠে. আর আমরা নির্দ্বিধায় বুক ঠুকে গর্বের সাথে বলতে জানি ---- ইয়েস, আমি ভোজনরসিক বাঙালি। আমরা যেমন খেতে জানি, তেমন খাওয়াতেও জানি। এ যেন আমাদের জন্মগত অনুচ্চারিত অহংকারবোধ!
যে কোন রোববার বা ছুটির দিনেই বাঙালি বাড়ির রসুইখানায় উঁকি না দিলেও তার সুবাসে আমরা টের পেয়ে যাই ---- আজ ভালমন্দ রান্না করছে দত্তকাকিমা বা সেনবৌদি বা ঘোষদার বৌ।
আর উৎসবের নাম যদি হয় নববর্ষ তাহলে তো কোন কথাই নেই!
আগেকারদিনে চৈত্রসংক্রান্তি পার্বণে মা, ঠাকুমা,দিদিমার হাতে বানানো টক, তেতো আর নিরিমিষ রান্না বাড়ির ছোটরা আর পুরুষেরা নির্দ্বিধায় খেয়ে নিত কারণ তারা জানতো রাত পোহালেই নববর্ষ। আর নববর্ষ মানেই সকাল হতে না হতেই রান্নাঘর থেকে নরম গরম লুচির সাথে নারকোল কুচো, কিসমিস দেওয়া ছোলার ডাল,বেগুন ভাজা, আলুর দমের সাথে আসছে একটা করে রসগোল্লা বা পান্তুয়া। সকালের খাবারটা যখন হজম হয়ে সময়টা দুপুরের দিকে গড়াতে থাকে তখনই মনটা কেমন যেন আনচান আনচান করতে থাকে দুপুরের মেনুর দিকে যেখানে আগে থেকেই খবর হয়ে যায় পাতে পড়তে চলেছে মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল,কুমড়োর ছক্কা,বেসনে চুবিয়ে ডুবো তেলে ভাজা, গলদাচিংড়ি মাছের মাথার বড়া, চিতলমাছের কালিয়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, পাঁঠার মাংস, কাঁচা আমের চাটনি আর শেষ পাতে ঘরে পাতা মিষ্টি দই ও বোঁদে।
কমবেশী করে সবগুলো পদই বাঙালিরা মা,কাকিমাদের ভালবাসার আব্দারে খেয়ে ঢেকুর তুলে হজমিগুলি ছাড়াই হজম করে নেয়।
একটু গড়িয়ে নিয়েই আবার হালখাতা করতে যাবার ধুম পড়ে যায় সারাটা বিকেল ও সন্ধ্যে জুড়ে।ছোট ছোট প্যাকেটে সুসজ্জিত সন্দেশ,লাড্ডু,নিমকি আর সরু গোটানো বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকা ক্যালেন্ডার ছাড়া কোন বাঙালি শিশুর নববর্ষ যেন আজও অসম্পূর্ণ।
যদিও এবারের নববর্ষ বাংলা সহ সারা বিশ্বের বাঙালির কপালেই ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রবল দাপটে মানুষের মনে আজ মৃত্যুর ছায়া ।
বাঙালি তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সচেতনতা দিয়ে এই অশুভ ছায়াকে ঠিক তাদের জীবন থেকে সরাতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী।
কথায় আছে না! 'আশায় বাঁচে চাষা' এই আশাটুকু বুকে নিয়েই তো এই কলম ধরা! কোনো ভাল কিছু কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখা,ভয়মুক্ত থাকা ও ভয়কে জয় করা। বাঙালির প্রাণের মানুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সুরে তাই গেয়ে উঠতে চায় আজ মন ---
" এসো হে বৈশাখ, এসো এসো / তাপস নিঃশ্বাস বায়ে,মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক্ যাক্ যাক্, এসো এসো...."
সবার জন্য রইল শুভ নববর্ষর অনেক শুভেচছা ।
তারিখ : ১লা বৈশাখ ১৪২৭, ইং ১৪ই এপ্রিল ২০২০