সবুজ সাধক রবীন্দ্রনাথ
বাংলা সাহিত্যের আকাশে যিনি চিরকালীন দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করেন, যাঁর সৃষ্টি আলো ছড়ায় মানবমনের গভীরে, তিনি আর কেউ নন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কাব্য, সংগীত, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকলা—প্রতিটি সৃষ্টিই যেন অনুভবের নির্যাস, বোধের দীপ্তি, আত্মার আলো। আর এই সব সৃষ্টির নিঃশব্দ, অথচ সুগভীর অনুপ্রেরণা যিনি ছিলেন, তিনি হলেন প্রকৃতি।
রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রকৃতি শুধু চারপাশের দৃশ্যজগৎ নয়, বরং এক জীবন্ত অনুভব—যার সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়তা। প্রকৃতি ছিলেন তাঁর কাছে সখী, উপাস্য, কখনো বা ঈশ্বরতুল্য। নিসর্গ তাঁর চেতনার অন্তরঙ্গ অংশ, এক অতলান্ত সৌন্দর্য যেখানে তিনি দেখতেন জীবনের ছন্দ, মৃত্যুর মৌনতা, প্রেমের মাতাল হাওয়া আর বেদনার অন্তরবেদ।
তাঁর শৈশবের দিনগুলো কেটেছে শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে, শিলাইদহের সবুজে ঘেরা নদীপারে, পতিসরের নির্জনতায়। সেই পরিবেশ তাঁকে শেখায় প্রকৃতিকে ভালোবাসতে, বুঝতে, গ্রহণ করতে। নদীর ঢেউ, গাছের পাতায় ঝিরঝিরে বাতাস, গোধূলির আবেশ—সবকিছুই তাঁর হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল এক নিবিড় আবেগে।
তাঁর গানে, কবিতায়, যখন উচ্চারিত হয়—
“আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ…”
তখন সেটি নিছক কাব্যিক অলংকার নয়, বরং এক ধ্যানমগ্ন আত্মোপলব্ধির উদ্ঘাটন—যেখানে আকাশ, আলো, নদী, পাখি—সব মিলিয়ে তিনি খুঁজে পান মহত্তম এক অস্তিত্ব, এক সর্বব্যাপী ঈশ্বরচেতনা।
ঋতুবৈচিত্র্য ছিল তাঁর সৃষ্টির এক অনিবার্য অনুষঙ্গ।
বসন্তে তিনি শুনেছেন প্রেমের মৃদুমধুর সুর,
বর্ষায় গেয়েছেন হৃদয়বেদনার করুণ সংগীত,
শরতে দেখেছেন অন্তরের শান্ত, ধ্রুপদী সৌন্দর্য,
আর গ্রীষ্মের দাবদাহে খুঁজে পেয়েছেন তৃষ্ণার দার্শনিক অন্তরসার।
তাঁর আহ্বানে—
“এসো হে বৈশাখ”—
ধ্বনিত হয় এক আগুনে শুদ্ধির যাত্রা, যেখানে পুরাতনের ক্লান্তি পুড়ে যায়, আর নতুনের আলো জ্বলে ওঠে আশার দীপ্ত শিখায়।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির মাঝেই লুকিয়ে আছে মানবজীবনের অন্তরসত্য। তাঁর “সভ্যতার সংকট”-এ উচ্চারিত সতর্কবার্তা আজও কাঁপিয়ে তোলে হৃদয়কে—
“মানুষ প্রকৃতিকে ভুলে গিয়েছে বলেই সে আজ নিজের কাছেই পরবাসী।”
এ এক অনন্ত সত্য, যা আজকের প্রযুক্তি-আচ্ছন্ন, যান্ত্রিক জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আরও প্রাসঙ্গিক, আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
শান্তিনিকেতনের জন্মও ছিল সেই উপলব্ধিরই প্রতিফলন। মাটির গন্ধ, গাছের ছায়া, পাখির ডাক—এসবের মধ্যেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি এক শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে বইয়ের পাতার বাইরেও শেখা যায় জীবনকে, প্রকৃতিকে, ভালোবাসাকে।
তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে বারবার ফিরে আসে সেই পাখি, সেই নদী, সেই চাঁদের আলো—যাঁরা সবাই যেন হয়ে উঠেছে হৃদয়ের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।
তিনি লিখেছেন—
“তুমি রয়েছ চিরদিন প্রকৃতির মাঝে”—
এ যেন এক মহাজাগতিক প্রেম, যেখানে ঈশ্বর আর প্রকৃতি মিশে যায় আত্মার গভীরতায়।
শেষে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতির এক নিষ্ঠ ও নিবেদিত পূজারী। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন—
প্রকৃতিকে বুঝতে পারলেই মানুষ নিজের হৃদয়ের সঙ্গে সংযোগ খুঁজে পায়।
এই ক্লান্তিকর, যান্ত্রিক, আত্মবিচ্ছিন্ন জীবনে আজও যখন আমরা ঘুরে ফিরি, তখন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে যেন বেজে ওঠে এক শাশ্বত আহ্বান—
“ফিরে চলো প্রকৃতির কাছে,
সেখানেই লুকিয়ে আছে তোমার হারিয়ে যাওয়া শান্তি,
তোমার হারিয়ে যাওয়া তুমি।”