অনন্ত প্রকৃতির পূজারী রবীন্দ্রনাথ
" আবার এসেছে আষাঢ় ছেয়ে
আছে বৃষ্টি সুবাস বাতাস বেয়ে
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
পুলকে দুলিয়া উঠিছে বাজি ----"
বিশ্বের সাহিত্য জগতের নক্ষত্র কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃত প্রকৃতি প্রেমিক। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রকৃতির পূজারী ছিলেন , তাঁর জন্ম বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ -- ইংরেজি ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দ ৭ ই মে । তিনি নিজেই জানিয়ে গেছেন -- " চির নতুনের দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ ।"
তিনি বাংলার গৌরব , ভারতের স্বর্ণ মুকুট -- বিশ্বের কবি সমাজের মধ্যমনি । বাল্যকাল থেকেই প্রকৃতি নিয়ে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন গল্পে ,নাটকে, উপন্যাসে,গানে -- কি সে নয়।
" ডাকঘর " নাটকে আমরা দেখেছি , ঘর বন্দী বালক রবীন্দ্রনাথ রাস্তার ধারে জানালা দিয়ে বাইরের খোলা এক মস্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে, দইওয়ালার মুখে তার গ্রামের গল্প শুনে পাহাড়, নদী দেখার ইচ্ছা। খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে দেখার সে কী ব্যাকুলতা !
" সোনার তরী " কবিতায় ঘন কালো মেঘের রূপের দৃশ্য , মেঘের গর্জনের, ধানের ক্ষেতের , ভরা নদীর রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন । ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন আষ্টেপিষ্টে । প্রকৃতি পূজারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবন আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁর সাহিত্য জগতে প্রকৃতিকে । পরিণত বয়সে লিখেছিলেন, "আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবনরাতি, স্মৃতি বেদনার মালা একখানা গাঁথি ---"
প্রকৃতি প্রেমিক কবি অনেক আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন প্রকৃতির প্রতি এত গভীর প্রেম কোনোও কবি তাঁদের কবিতায় দেখাতে পারেন নি । মনুষের প্রেম ভালোবাসা থেকে আসে ভক্তি, শ্রদ্ধা আর সেই ভক্তি শ্রদ্ধা থেকেই মানুষ পূজারী হয়ে ওঠেন। প্রকৃতি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয় জুড়ে, তিনি প্রকৃতিকে নিছকই মানুষের উপভোগ বা রসা স্বাদনের বিষয় হিসাবে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি অতি ভক্তি শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকৃতিকে দেখেছিলেন । প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি প্রকৃতির প্রেমে পড়ে প্রকৃতির পূজারী হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি বাংলায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, বাংলার মাটিতে বেড়ে উঠেছিলেন । বাংলার খোলা আকাশ, মাঠ, নদীর সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান। তাই তাঁর কবিতায় বার বার প্রতিফলিত হয়েছে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ। প্রকৃতি ও পরিবেশ চিন্তা ভাবনাতে তাঁর মস্তিষ্ক ছিল অগ্রগামী । প্রকৃতির প্রতি মমত্ববোধ শিশুকাল থেকেই তিনি প্রকাশ করেছেন ।
" তৃণ পুলকিত যে মাটির ধরা লুটাইয়ে আমার সামনে, সে আমারে ডাকে এমন করিয়া কেন যে কব কেমনে...."।
প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেম ছিল বিশুদ্ধ এবং গভীর। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রকৃতির সন্তান বারংবারই তাঁর জীবনে ও বৈচিত্রে সাধনায় প্রকৃতিকে পৃথক পৃথক স্থান দিয়েছেন এটা চিরন্তন সত্য যে, এই পৃথীবিতে প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক ।
" ছিন্নপত্র " গদ্যগ্রন্থে তিনি তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে প্রকৃতির যে বার্তা দিয়েছেন একজন কবির প্রকৃতির প্রতি যতটা মমত্ববোধ ও গভীর প্রেম থাকলে এবং প্রকৃতির প্রতি নিজের আত্মার মিলন ঘটাতে পারলে তবেই সম্ভব। তিনি যেন নিজে কান পেতে অন্তরে ধারণ করেছিলেন পদ্মার ঢেউ, কবির মন হরণ করেছিল পদ্মার রূপ , লাবণ্য । তিনি অনুভব করেছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপে জনজীবনের সংস্কৃতি মিশে আছে পদ্মাতে । ছিন্নপত্রের প্রতিটি পত্রের অন্তর্গত মাটির গন্ধ, আকাশের অনির্বচনীয় রূপ, সন্ধ্যা, রাতের বৈচিত্রপূর্ণ আকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির গভীরতায় ও ভাষার সহজাত ভঙ্গিমায় শিল্পীর রূপ পেয়ে পত্রগুলি চিরকাল মানুষের জীবনে জগৎ সংসারে উপকরণ হয়ে থাকবে ।
এই প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রেমিক মহানপুরুষ মানুষকে শিখিয়েছেন প্রকৃতির কাছাকাছি এসে প্রকৃতিকে দেখলে মানুষের প্রতি দরদ জন্মায় । রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং মানব মনের উপর তাঁর সীমাহীন প্রভাব আমাদের মুগ্ধ করে । এই প্রকৃতি প্রেমিক একদা শুনিয়েছিলেন দেশ কালজয়ের মন্ত্র , তিনি বলেছিলেন -- " মানুষের দেবতাকে স্বীকার করে এবং প্রণাম করে যাব , আমার জীবন দেবতা আমাকে সেই মন্ত্র দিয়েছেন ।........ আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে প্রণাম করেছি মহৎকে..... " ১৯১৩ খ্রীষ্টব্দে
ইংরেজি ভাষায় অনুদিত " গীতাঞ্জলি" কাব্যটির জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান । প্রকৃতি প্রেমিক, প্রকৃতির পূজারী রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র সাহিত্য জগতে চিরকালীন মানুষের কাছে
চলার অমিয় সাহিত্য সম্পদ রেখে গেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্য আদর্শের উজ্জ্বল দীপশিখা।
নানান কথামালায় তিনি বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। তিনিই একমাত্র প্রকৃতি প্রেমিক যিনি বলতে পেরেছিলেন পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে হবে । দীর্ঘ জীবন প্রবাহে তাঁর লেখনীতে তিনি বুঝিয়েছেন পরিবেশ ও প্রকৃতি পারে মাটি ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ভাবনা বাংলা বা ভারতে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় স্থান অধিকার করে আছে । শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির কোলে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন যেখানে প্রকৃতির কাছাকাছি এসে আদর্শ পরিবেশের মধ্যে শিক্ষাথীরা স্বাধীনভাবে শিক্ষালাভ করবে । শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি, মানুষ ও শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ।
প্রকৃতি প্রেমিক কবির মন বিচরণ করত জলে , স্থলে ও অন্তরীক্ষে। প্রকৃতির কোনও কিছুই তুচ্ছ ছিল না, সবই ছিল মহিমামন্ডিত । সাহিত্য জগতের এই মহানপুরুষ রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেম ছিল অতুলনীয় ও অপরিসীম।