কাপ প্লেটে নববর্ষ
হয়ত অনেকেই ভাববে এ আবার কেমন নাম? এটা একটা অনুভূতির নাম! আমার নববর্ষ; পুরোটাই, আমার ছেলেবেলার স্মৃতির আবেগ মেশানো মধুর নববর্ষ। মধু বলতে আমার কাছে এখন সেটাই লাগে। আসলে আমরা যত বড়ই হই, জীবনযাত্রা যত কঠিন হোক, ঘাত, প্রতিঘাত, আমিত্ব এসবের মধ্যেই পুরোটা জায়গা জুড়ে বাস করে শিশু সত্ত্বা । সে সারা জীবন আমাদের সাথেই থাকে। তাইতো আমরা বারবার ভুল করি। ছোটদের মতো অভিমানে কেঁদে ফেলি। অনেক সময় ছোটদের মত কান্না লুকোতেও পারি না। বুড়ো বয়সেও বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করি। আমাদের আসলে হাত -পা বড় হয়, মন বড় হয় না। আমার ছেলেবেলা কেটেছে ওপার বাংলার পাবনা শহরে। ইছামতি নদী পাবনা শহরের মধ্যে দিয়েই বয়ে গেছে। ছেলেবেলায় কত স্নান করেছি। পাবনা শহর শুধু মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্যই বিখ্যাত না। এখানে জন্মেছেন ঠাকুর শ্রী শ্রী অনুকূলচন্দ্র । বাংলা সাহিত্যের দিকপাল প্রমথ চৌধুরী, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, অপরেশ লাহিড়ী (বাপি লাহিড়ীর বাবা) আরো অনেক গুনি মানুষের বাস। নাম বলতে গেলে পুরো পাতা ভরে যাবে। পাবনা অনেক পুরনো শহর, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। অনেক বিখ্যাত সব স্থপতি এখানে আছে। নববর্ষ উপলক্ষে এখানে অনেক বড় মেলা হয়, জয় কালী বাড়ি মন্দির প্রাঙ্গণে।
মাটির বাসন, দোয়েল পাখি, গরু, ঘোড়া, বাঘ সেই দেখতেও কিনতে কতবার যে যেতাম, কি যে এক অমোঘ টান, সেটা এখন আর বলে বোঝানো যাবে না। তখনকার দিনের বাবা- মায়েরা ছেলে-মেয়েদের একা ছাড়তে ভয় পেতেন না। কারণ আজকের দিনের মত এত অঘটন, বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে আমরা যে চিন্তায় থাকি তখনকার দিনে তা শুনিনি। ওখানে প্রতিষ্ঠিত সব মন্দিরে নববর্ষ হয়। মায়ের সাথে পাবনার জয় কালী মন্দিরে নববর্ষ করতে যেতাম। মন্দিরের খাতায় নাম তুলে বাতাসা দিতেন। আমি কিন্তু, আজকে অন্য নববর্ষের গল্প বলবো। সে হল, কমলদার দোকানের নববর্ষ। কমল দা হলেন পাবনার তাঁতি বন্ধের জমিদার বাড়ির ছেলে। তাঁতি বন্ধের জমিদার হলেও পাবনা শহরে আমাদের পাড়াতেই ছিল তাদের বাস। আমি যখন ছোটবেলায় তাদের বাড়ি দেখি তখন একদমই ভগ্ন দশা। মায়ের কাছে শুনেছি, কমলদার মা ছিলেন দরিদ্র বাড়ির রূপসী মেয়ে। আমিও তাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখেছি সত্যি সে সুন্দরী। জমিদার অন্নদা গোবিন্দ রায় চৌধুরী ঘোড় সওয়ারে বেরিয়ে এক প্রজার বাড়িতে এসে জল চাইলে, বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি জল নিয়ে আসে। জমিদার মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হয়ে মেয়ের বাবাকে বলে, তুমি জলের সাথে তোমার মেয়েকেও আমার কাছে দান করে দিয়েছো। অসহায় দরিদ্র বাবা, জমিদারের আগের বউ থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট মেয়েটিকে জমিদারের হাতে তুলে দিলেন। এই জমিদারদের সম্পর্কে অনেক গল্প আছে। এঁরা ছিলেন অনেক অত্যাচারী ছিল।বাড়ির সামনে দিয়ে কাউকে জুতো পড়ে ও ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে দিত না। ছাতা বগলে, জুতো হাতে নিয়ে যেতে হতো। বাড়ির রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে তাকে জেরার মুখে পড়তে হত। জমিদার অন্নদা গোবিন্দ রায় চৌধুরী ছিলেন কালি সাধক। তিনি একরাত্রে এক'শ আটটা কালীপুজো প্রথম পাবনাতে করেন। এর কিছুদিন পর পাগল হয়ে যান। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন আর মাভই মাভই বলতেন। পরে অন্ধ হয়ে মারা যান। দেশভাগের পর ওদের পরিবারের প্রায় সবাই এদেশে চলে আসেন। জমিদারের প্রথম পক্ষের ছেলে মেয়েরা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং অর্ধ বৃত্তের মালিক। অপরদিকে দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়েদের তেমন শিক্ষা ও অর্থ কোনটাই ছিল না। ফলে তারা পাবনাতেই থেকে যায়। পাবনার যা জায়গা জমি, বাড়ি ঘর ছাড়া সবই সরকার নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে বাড়ি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামমাত্র মূল্য দিয়ে উঠিয়ে দেয়। এখন জমিদারের নামে পাবনাতে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক হল, পাবলিক লাইব্রেরী হয়েছে। ছোটখাটো কাজ ও পরের বাড়ি বাসন মেজেই ছোট পক্ষের ছেলে- মেয়েদের দিন কেটেছে। এই বাড়িরই ছোট ছেলে কমলদা। কমলদাকে ঠিক দাদা বলা যায় না, আমার মাকে তারা বৌদি বলতেন। কিন্তু সবাই কমলদা বলত দেখে আমরাও বলতাম। কমলদার, পাড়ায় ছোট্ট একটি মুদি দোকান ছিল। কিছু দরকার হলে মা ওখান থেকেই কিনতে পাঠাত। ছোটবেলায় আমার এক খেলার সাথী ছিল। নাম বেবী, যে এখনো আমার বন্ধু হয়েই আছে। সব জায়গায় একসাথেই যেতাম। সেই কমলদার দোকানেরও খরিদ্দার আমরা। নববর্ষের অনেক আগেই আমাদের নিমন্ত্রণ হয়ে যেত। সেই খুশিতে আমরা ও আগে থাকতে খুব আনন্দে থাকতাম। সকালেই নববর্ষ করতে চলে যেতাম। আমরা কমলদার দোকানের স্পেশাল গেস্ট ছিলাম। অন্তত আমাদের তাই মনে হত। আমাদের দুজনেরই বয়স তখন ৫-৬। কিন্তু দাদা ঐদিন আমাদের খরিদ্দার হিসেবে ভীষণ সম্মান করে আপ্যায়ন করত। আমাদের যত্ন করে বসিয়ে - সিঙ্গারা , নিমকি, গজার সাথে এক কাপ চা খেতে দিতেন, প্লেটে করে। এতে আমাদের আনন্দে ও গর্বে মনটা ভরে যেত। কারণ কেউ আমাদের চা খেতে দিত না ওই বয়সে। তারপরে আবার কাপ প্লেটে করে চা এতে আমরা ভীষণ সম্মানিত বোধ করতাম । সেই কাপ প্লেটে চা খাওয়ার যে অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না। এখন কত নববর্ষ আসে, কত উপহার পাই কিন্তু কমলদার দোকানের সেই ভালোলাগা আর আসে না। আবার সেই পুরনো কথাতেই ফিরে আসি- হাতে পায়ে যতই বড় হই, বয়স যতই বাড়ুক, আমি বড় হতে পারিনি। আমার কাছে নববর্ষ মানেই কমলদার দোকান।