অন্য কোজাগরী
কলকাতার মত আলোকোজ্জ্বল শহরের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছে সোনাগাছির সেই অন্ধকার, ক্লান্ত গলিগুলি— যেন সময়ের ঘষা লেগে আরও কিছুটা আহত অথচ শুকনো - পুরনো এক অমলিন ক্ষতচিহ্ন। সরু পথ, সোঁদা আর ঘুপচি বাতাস, পঙ্কিল ধুলো আর সস্তা আতরের গন্ধে মিশে থাকে প্রতিদিনের অব্যক্ত এক বিষণ্ণতা।
তবু বছরে কয়েকটা দিন আসে, যেই দিনগুলিতে অন্ধকারও যেন আলোকে গায়ে মাখতে চায়, আলোর ছোঁয়ায় জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে চায়। আজ তেমনই অনন্য এক দিন— অন্য দিনের তুলনায় যেন বেশ কিছুটা দীপ্ত, একটু বেশিই জীবন্ত। আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। আকাশে রুপোর থালার মতো ঝলমল করছে পূর্ণিমার দীপ্তিময় চাঁদ, তার স্নিগ্ধ আলোয় নিষিদ্ধ - বদ্ধ গলিগুলিও আজ যেন নতুন করে নিশ্বাস নিচ্ছে।
বছরের এই এক রাত যেন নিষিদ্ধপল্লীর বুকেও ছড়িয়ে দেয় এক অচেনা জ্যোছনা। যাদের নিজের "গৃহ " বলে কিছুই নেই, তারা আর গৃহলক্ষ্মীর পূজার্চনা করবে কেমন করে? এসব তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। তবুও লোভ হয়। একটা পরিপাটি গৃহের লোভ, লাল টুকটুকে বেনারসি পরিহিতা কনে-বউ সাজার লোভ, নির্ঝঞ্ঝাট সুখময় সংসারের লোভ, হইহই করে গৃহলক্ষীকে পুজো করার লোভ। কিন্তু অভাব তাদের সব লোভকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। তাই সব লোভ সামলে উঠলেও, লক্ষ্মী পুজোর দিন আনন্দ উপভোগ করার এই লোভ টা আর সামলে উঠতে পারেনি। তাই রাতে ঘণ্টার পর ঘন্টা দৈহিক খাটুনির পর, হাজার কাটাছেঁড়ার পর, অক্লান্ত পরিশ্রম করে খর জোগাড় করে, বাঁশ-ছাউনি টেনে গড়ে তুলেছে তাদের অস্থায়ী মন্দির। সেখানেই আজ মৃন্ময়ী মা কমলার পূজা হবে। কোজাগরীর এই পূর্ণ তিথিতে, রক্তমাংসের মায়ের হাত ধরেই মৃন্ময়ী মা প্রবেশ করেন প্রতি গৃহে। মা প্রবেশ করেন প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি ক্লান্ত হৃদয়ে — সঙ্গে বয়ে আনেন আলো, আশার কিঞ্চিৎ সুবাস, আর অন্তত একরাতের জন্য হলেও বিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন — এই অন্ধকারের শেষেও একদিন ঠিক প্রভাতের নরম আলো উদিত হবে।
"বেশ্যা"পাড়ায় গলির একদম শেষ মাথায় একটা ভাঙাচোরা স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণে পরিবৃত ঘর। সেখানেই থাকে মেঘলা, ভারী সৌখিন একখানা নাম। মেঘলা শহরের কুখ্যাত যৌনকর্মী গৌরীর একমাত্র আদরের মেয়ে। গৌরীর দাম এখন "শরীরের বাজারে" সব থেকে বেশী। বছর চব্বিশের গৌরীর যৌবনে কত পুরুষ উন্মত্ত। গৌরীর সুডৌল স্তনের ছোঁয়া কেবল শহুরে বাবুদের সুখ দিয়ে গেছে এতকাল , তাই নিজের মেয়ের মুখে সেই দুগ্ধামৃতের স্বাদ তুলে দিতে সেভাবে পারেনি সে। জন্ম থেকেই মেঘলা তাই কঠিন অসুখ সেরিব্রাল পালসি আর অপুষ্টির মত অভিশাপের শিকার। মেঘলার মুখে ভুবনমোহিনী সেই নিষ্পাপ শিশুসুলভ হাসি, কিন্তু শরীরের গঠন যেন প্রকৃতির এক নির্মম পরিহাস। ওর হাত কাঁপে নিরন্তর, আর বাঁ পাটা অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে থাকে। তবু চোখদুটো — আহা, সেই চোখদুটোতে যেন আশ্চর্য এক দীপ্তি! যেন কারও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সেখানে নীরবে প্রতিফলিত হয়ে আছে।
ফি বছরের মতই এবারও কদিন আগেই দুর্গাষষ্ঠীতে সব্বার প্রিয় ঢাকি কাকু এসেছিলেন, নিষিদ্ধপল্লীর অনতিদূরে শোভাবাজার রাজবাড়ী লাগোয়া রথীন্দ্রদের বনেদী বাড়ির উমা পুজোয় ঢাক বাজাতে। ঢাকি কাকুকে ওরা প্রতি বছরই বায়না করে। আগে ঢাকি কাকুর বাবা, দাদু বাজাতেন। বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এই বায়নার প্রথা। "বেপাড়ার" মেয়ে গৌরী প্রায় বছর চৌদ্দ থেকেই দেখেছে এই কাকুকে প্রতিবছর ঢাক বাজাতে; তাই গৌরী সে থেকেই রথীদের মুখে শুনে শুনে "ঢাকি কাকু" বলেই সম্বোধন করে তাকে। তবে ঢাকি কাকুর আসল নাম কিন্তু রমেন মিস্ত্রী। ঢাকি কাকু দুগ্গা পুজো থেকে একেবারে লক্ষ্মী পুজো অবধি কাটিয়ে , দেদার ঢাক বাজিয়ে তারপর নিজ গ্রামে ফিরে যান। প্রতি বছরই ঢাকি কাকু সঙ্গে করে ছেলে নবীনকে নিয়ে ঢাক বাজাতে আসেন, কিন্তু এবার একাই এসেছিলেন।
হঠাৎ গৌরী দেখল দশমীর দিন কাকু তড়িঘড়ি করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছেন ...
গৌরী প্রায় অনেক বছর ধরেই রথীন্দ্রদের বাড়ির মেয়ে "উমা", তাঁর পুজোয় প্রতিমা গড়ার জন্য পতিতালয়ের মাটি সরবরাহ করে। সেই সুবাদেই কাকুর সাথে অল্প বিস্তর চেনা শোনা আর কি! সেই ছোট্ট বেলায় হতভাগ্য গৌরীকে ওর প্রাণাধিক প্রিয় দুই দাদা রাখীর দিন এই চরম অন্ধকারে বেঁচে দিয়ে গিয়েছিল। ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় গৌরীর বাবা মা দুজনেই গত হয়ে যাওয়ার পরপরই। চৌদ্দ থেকে চব্বিশ। প্রায় এক দশক। তাই ঢাকি কাকু ওকে প্রায় বড় হতে দেখেছে বললেই চলে।
> — “ কাকু, কি গো এবার এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছ গো ?” — গৌরী জিজ্ঞেস করেছিল।
— “ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা রে। তাই ও ব্যাটা আসেনি। জানিসই তো, ছোট থেকেই ওর মা নেই, বাপ-ব্যাটায় সব করি। ছেলেটা কদিন একা হাতে রেঁধে বেড়ে খাচ্ছে। তাই ছুটছি লো। দুদিন থাকলে হবে নে।”
কাকুর কথায় স্পষ্ট ব্যস্ততা বোঝা গেলো।
গৌরী, পুজো ক'দিন রাত্তিরে গোঁসাই বাবুর নৃত্যসভায় "বাইজি নাচ" করে বড় গোঁসাইয়ের কাছে বেশ ভালো রকমের ইনাম আদায় করেছে। গৌরী হেসে সেই টাকার অর্ধেক ঢাকি কাকুর হাতে দিয়ে, বলল—
> “আচ্ছা কাকু, পরের বার ফিরলে মিষ্টি নিয়ে আসবে কিন্তু। নবীন, আহা সেই আমাদের ছোট্ট ছেলেটা নাকি মাধ্যমিক পাশ দেবে বলে কথা!!! ”
রমেন কাকু এক মুখ হাসি নিয়ে বললেন—
> “এইবার মা চাইলে, আমি তোদের সকলের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসব লো। অনেক আশা, ছেলেটা ফি বছর ফাস্টো হয়। আশীর্বাদ কর লো তোরা সবাই , যেন এবার মাধ্যমিকে ওর নাম কাগজে বের হয়। ”
কাকুর সেদিনের প্রাণোচ্ছ্বল হাসিটা যেন আজও গলির দেয়ালে রয়ে গেছে। কিন্তু পরের বছর তো কাকু আর ফেরেনি। দুর্গা পুজোয় কাকু আর আসেনি... মিষ্টি নিয়ে তো কাকুর আসার কথা ছিল, তবে? গৌরী জানত না, যে কাকুর সেই হাসি থেমে গেছে অচিরেই।
কয়েক সপ্তাহ পর খবর এলো অবশেষে। কাকুর দূর সম্পর্কের এক ভাইপো চূড়ান্ত শোকের খবর নিয়ে এসে হাজির হল রথীন্দ্রদের বাড়ির পুজো দালানে। সেই দুঃসংবাদ খুব কম সময়ে চাউর হল এদিক ওদিক। শোনা গেল, ঢাকি কাকুর একমাত্র আদরের ছেলে নবীন, মাধ্যমিকে ভীষন ভালো ফলাফল করে ভর্তি নিয়েছিল গ্রামেরই এক উচ্চবিদ্যালয়ে। বরাবরই নবীনের ইচ্ছে ছিল কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে গ্রামের কৃষকদের উপকার করবে সে। সে বছরই বিশ্বকর্মা পুজোর পরের দিন দুপুরবেলা তাদের নিজেদের ধান ক্ষেতে বাকিদের সাথেই কাজ করছিল নবীন। সেখানেই এক মস্ত বড় বিষাক্ত সাপের কামড়ে সে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। নাহ, সে যাত্রায় তাকে আর তাদের কুলদেবী মা মনসাও বাঁচাতে পারেননি। প্রথমে স্ত্রী, তারপর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোকে কাকু যেন ক্ষয়ে যেতে লেগেছে ভেতর থেকে। কাকু আর তাই ঢাক বাজাতে পারেন না। ঢাকের আওয়াজে তার নিজের বুকের কান্না মিশে থাকে।
খবরখানা শোনার পর গৌরী সেদিন আর খদ্দের নেয়নি। খুব কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। মেঘলা কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনুভব করেছিল সন্তান হারিয়ে ফেলার ভয় আসলে কি! গৌরীর ভয় হয়, মেয়েকে না সে পিতৃপরিচয় দিতে পেরেছে, না স্বাভাবিক জীবন। তার মধ্যে মেয়ের এই রুগ্ন অসুস্থ শরীর। তাই যে পথে সে রোজগার করছে, সে পথ মেঘলার জন্য বন্ধ।
গৌরী নিজের মনেই কোথাও না কোথাও ঠিক জানত যে গৌরীর প্রতি রমেন কাকুর স্নেহ ছিল নিখাদ — যদিও রক্তের সম্পর্ক নয়, কিন্তু সেই স্নেহে পিতৃত্বের মমতা মিশে থাকতো। কাকু আগের বারও পুজোতে এসে মেঘলার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “ডরিস না লো মা, তোকে দেখে মনে হয়, এই গলির মধ্যে একটুকরো আলো বুঝি তোর জন্যই বেঁচে আছে।” মেঘলাকে রমেন কাকু নিজের নাতনী ব্যতীত অন্য কিছু মনে করতেন না । রক্ত জল করা শুকনো শিরার ভারে জরাজীর্ণ কাঁপা হাতে মেঘলাকে রমেন কাকু আদর করতেন, মাথায় হাত রাখতেন। মেঘলাকে দেখে রমেন কাকুর বরাবরই মায়া হত। মেয়েটা অমন সুন্দর দেখতে কিন্তু না চলতে পারে ভালো করে, না মুখে কথা ফোটে পরিষ্কার। কি যে এক প্রগাঢ় সমস্যা!
ছেলের মৃত্যুর দুবছর পর কাকু, এবছর ফের পুজোয় ফিরেছিলেন রথীন্দ্রদের উমা পুজোয়। কাকুর থাকার কথা ছিল লক্ষ্মীপুজোর দিন অবধিই। উমাপুজোর পর কাকু অন্যান্য পাড়ায় বাকি গ্রামবাসীদের জন্য মুড়ি চিরে চাইতে বের হন। ঢাক বাজিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে দু এক পয়সা বাড়তি কামাই হয় এই পুজোর দিনে।
তবে, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ঠিক দু’দিন আগেই গলির নিস্তব্ধ আকাশে নামল এক পৈশাচিক ঝড়। মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু ভেসে গেল বিশৃঙ্খলার অন্ধ ঘূর্ণিতে। এক মায়ের পূজার আগমুহূর্তে অন্য এক মায়ের দেহ ভেসে গেল রক্তে। মানুষের ছদ্মবেশে পশুরূপী নর পিশাচেরা ছিঁড়ে খাবলে খেল গৌরীর মাংস, নিংড়ে নিল ওর শেষ নিঃশ্বাস। সেই অভিশপ্ত রাত্রে, তিনজন ধনী বাবুর হিংস্র লালসায় দগ্ধ হয়ে, ধর্ষিত হয়ে গৌরী শেষমেশ মৃত্যুকেও আপন করে নিল — যেন পৃথিবীর অন্যায়ের সমস্ত ভার নিজের দেহে বহন করে মুক্তির পথ বেছে নিল সে।
নাহ! কোন মামলা মোকদ্দমা কিছুই হল না এই খুনের। কোন কিনারাই হল না। নষ্ট মেয়েদের আবার ধর্ষণ কি? তাদের যে বিচার পাওয়া মানা। ছোট্ট মেঘলা দরজার আড়ালে বসে, মায়ের ঠাণ্ডা শক্ত হাত বুকে চেপে, এক মনে মাথা গুঁজে খুব কাঁদছিল। কিছু একটা বেশ বলতে চাইছিল মা কে, কিন্তু কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিল না।
পরদিন সকালে পাড়ার সবার কাছে খবর পেয়ে ঢাকি কাকু ছুটে এলেন গলির সেই পরিত্যক্ত নিষিদ্ধ বাড়িতে। আজ মেয়েদের প্রত্যেকের কাজে ভাটা পরবে - খাবারও জুটবে না দুই তিন দিন । এসব কিছু জেনেও সমস্ত মেয়েরা কাঁদছে গৌরীর পাশে দাঁড়িয়ে, কেউ রাতের চিরাচরিত সাজ চাপিয়ে দিচ্ছে ওর দেহে। কামড়ানো অর্ধেক খেয়ে ফেলা ঠোঁট দুটো দুমড়ে মুচড়ে এক সার। তবুও শেষবারের মত একটু রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে । মেঘলা যদিও এক কোণে বসে থর-থর করে কাঁপছে। রমেন কাকু তখন বুদ্ধিভ্রষ্ঠ , কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে মেঘলার মাথায় হাত রেখে বললেন—
> “ভয় কি মা, আমি আছি তো। তুই এখন থেকে আমার একার মেয়ে, আমার সাথে থাকবি।”
তারপর গোধূলিতে মেঘলার ওই ছোট্ট দুটো খানিক বাঁকা হাত, কুশ কাঠি করে আগুন ধরিয়ে দিল কষ্টে যন্ত্রণায় মলিন হয়ে যাওয়া ওর মায়ের মুখে।
দুদিন পর কোজাগরীতে লক্ষ্মীপুজো এলো সেবারও। বাকি পাড়ার মত রংচঙে আলো এবার আর জ্বলল না, গমগমে মাইকের কান ফাটানো অত্যাচারের বালা ও নেই, ঢাকের বাদ্যিও বাজলো না এবার এখানে। কারণ রমেন কাকুর মন ভারী খারাপ।
তবু রমেন কাকু লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন সকালে বুকে পাথর চাপা দিয়েই , অসুস্থ মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে সকলকে আশ্বস্ত করে বললেন -
> “এ বছরও মা কমলা আসবেন। চিন্তা নেই। আমাদের গলিতেও আসবেন মা লক্ষ্মী।”
গলির প্রায় সমস্ত যৌনকর্মীরা মিলে পতিতা গৌরীর বাড়ি, ঠিক যেখানে গৌরী দিনের পর দিন নিজেকে বেচে বাঁচত, আদরের মেঘলাকেও বাঁচিয়ে রাখতো সেই বাড়ির মাটি নিয়ে এলো। পতিতালয় থেকে কেটে এনে দলা করা সেই মাটিতেই তৈরি হল এবারের লক্ষ্মী প্রতিমা — শহুরে বাবু ও তাদের স্ত্রীরা রঙ্গ করে ফি বছরের মতই বললেন “বেশ্যা বাড়ির ঝি তে, লক্ষ্মী গড়ে কি তে?” ... ইত্যাদি, প্রভৃতি।
সেসব আকথা কুকথায় কর্ণপাত করল না কেউই। তবে একদিনে প্রতিমা বানানো তো সম্ভব নয়। তাই কুমোর পাড়া থেকে মায়ের প্রতিমা এনে মায়ের উন্মুক্ত দেহে ছোঁয়ানো হল পতিতালয়ের মাটি, পড়ানো হল ঝলমলে গহনা শাড়ি। সাজানো হল দালান, আলপনা দিল মেয়েরা। রমেন কাকু উমা পুজোর পর আবারও মন খুলে প্রাণ ঢেলে ঢাক বাজালেন একা হাতেই। তার ঢাকের তালে কাঁপা হাতে মেঘলা ফুল দিল প্রতিমার রাঙা পায়ে। রমেন কাকু ওমনি উৎফুল্ল হয়ে , ঢাক খানা নামিয়ে রেখে , আহ্লাদী মেঘলাকে কোলে তুলে নিলেন। মেঘলার মুখে হাসি যেন আর বাঁধ মানে না। মেঘনা রমেন কাকুর এই ব্যবহারে একটু অবাক হল ঠিকই, কারণ "বাবা" শব্দটার সাথে , পিতৃস্নেহের সাথে তার পরিচয় একেবারেই নেই। তবুও মেঘলা এই অচেনা স্নেহে ভারী আনন্দ পেল। অনেক দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও যেন এবারের লক্ষ্মী পুজো হল সাধ্যমতো ঘটা করেই। হয়তো বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ পুজো করা সম্ভবপর হয়নি , তবে অসীম আন্তরিকতা ছিল এই পুজোতে। সব বাইজিরা নিজেদের সমস্ত সামর্থ্য উজাড় করে পুজো করেছেন এইবার - সবটাই গৌরীকে দেওয়া সম্মানের উপলক্ষে। আড়ম্বরহীন এই পুজোর এমন প্রচার ঘটলো যে সন্ধ্যাবেলা বড় বাড়ির বাবুর - বৌঠাকুরাণীরা এসে দাঁড়িয়ে মায়ের পুজো দেখেছিল। সেদিন কেউ কটূক্তি করে হাসেনি, কেউ ঘৃণা করেনি — সবাই কেবল নিঃশব্দে দেখল, মা কমলা যেন সত্যিই এসেছেন সবার মাঝে। ধূপ ও ধুনোর ধোঁয়ায় ভেসে উঠল গৌরীর মুখ, তারপর ঢাকি কাকুর ছোট্ট ছেলে নবীনের মুখ — দুজনেই যেন পরম আশীর্বাদ করছে প্রাণ ভরে মেঘলা আর রমেন কাকুকে।
রাত্তিরে রমেন কাকু মেঘলাকে নিয়ে রথীন্দ্রদের বাড়ির একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। যেখানে ঢাকি কাকু ফি বছর এসে থাকেন। কাকু মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললেন—
> “জানিস মা, আমার ছেলে যেভাবে আমাকে ডাকত, তুইও ঠিক তেমন করেই যেন আমাকে ডাকিস। তুই যখন নিজ হাতে প্রতিমার পায়ে পুষ্প নিবেদন করলি, মনে হল স্বয়ং মা কমলা তোর হাতে পুজো নিতে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। তুই আজ প্রমাণ করে দিয়েছিস, তুই এই গলির আলো, তুই-ই আমার আসল পুজোর প্রতিমা।”
মেঘলার চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠলো অশ্রুতে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট ভাবেই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো -
> “আমি তো ঢাক বাজাতে পারি না দাদু, কিন্তু আমি তোমার জন্য অনেক ফুল এনে দেব — যতদিন পারবো।”
রমেন কাকু মেঘলার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। মাথায় অনেক করে হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
কোজাগরীর পরদিন রাত্তিরে সব ঠাকুর পর পর বিসর্জন হওয়ার ফলে ঢাকের আওয়াজ যেন হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ থেমে গেছে। আলোকসজ্জা স্তম্ভিত হয়ে গেছে। আবার সেই অন্ধকার গলিতে নিয়মিত খদ্দেরের ভিড় বাড়ছে দরজায়
দরজায়। রমেন কাকুর এবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কাকু ব্যাগপত্র গুছিয়ে মেঘলাকে নিয়ে ভোর হওয়ার আগেই শেষ রাতে ফিরে গেলেন। কেউ জানে না, তারা কোথায় গেল —শুধু প্রতিমার পায়ের কাছে একটা ছোট থলে রেখে গেলেন রমেন মিস্ত্রি, ভিতরে দুই প্যাকেট নারকেলের মিষ্টি — আর চিরকুটে লেখা,
> “তোদের সবার মা তোদের মধ্যেই আছেন রে। খুঁজে পাবিই পাবি। দেখিস। ভালো থাকিস।
– ইতি তোদের ঢাকি কাকু।”
বিশ বছর পর, আবারও কাল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। ওই গলিতে লক্ষ্মী পুজোর তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে গেছে আবার। সবাই এখন এক ডাকে “গৌরিবাড়ির লক্ষ্মী প্রতিমা" চেনে।
প্রতি বছর মেঘলার মত আরও অনেক ছোট্ট "আলো"রা কাঁপা হাতে প্রতিমার সামনে ধূপ জ্বালে, এঁকে নেয় নিজের ভবিষ্যতের সোপান। রমেন কাকুর হাতের ঢাক আর বাজে না — তবু বাতাসে আজও স্মৃতি - স্নেহ মিশে থাকে। উৎসব হয়। নানাবিধ অনুষ্ঠান হয়।
মেঘলারা আলো বয়ে আনে। মা আলো বয়ে আনেন।