ছোটগল্প - শুক্লা দিদির গল্প
শুক্লা দিদি সুন্দরী ছিল না। গায়ের রঙ ফর্সা হলেও অসম্ভব স্বল্প উচ্চতা, পুরু ঠোঁট, উঁচু কপাল ইষৎ পিঙ্গল চোখ তাকে সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি থেকে অনেকটা নীচেই রাখতো।
শুক্লা দিদি ভাই বোনেদের মধ্যে সবার ছোট ছিল। সবার সংসার গড়ার শেষে শুক্লা দিদির জন্য কিছুই আর ছিলনা। ছোড়দাদার সংসারে ঠাঁই হল তার আর বিধবা মা রইলেন বড় দাদার সঙ্গে। ছোড়দাদার ছেলে মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব সাগ্রহে শুক্লা দিদি কাঁধে নিয়েছিল। ছোট বৌদি ছিল ঝারা হাতপা। ছোড়দাদার সঙ্গে বিদেশে চলে গেল দিব্যি ছেলে মেয়েদের ননদের কাছে রেখে। ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে পরিবারের মধ্যে বা বাইরে কারো কোনো কথা বলার জায়গাই ছিল না। সবাই জানতো টুলু বুলুর ছোট পিসি হলে বাবা মা লাগে না।
এভাবেই একটা স্থিতিশীল পরিবেশে শুক্লা দিদি দিব্যি ছিল। তার নিজের ঘর সংসারের ইচ্ছে কোনোকালে হয়েছিল কিনা কেউ জানেনা। দাদারা হাত খরচ দিতো। তাতেই ও খুব খুশি থাকতো। কোনো বাড়তি চাহিদা ছিলনা ওর।
সেবার পুজোর পর বিজয়া করতে মায়ের কাছে গিয়েছিল আজিম গঞ্জে, বড় দাদার বাড়িতে। ফিরে এসে দেখে ছোড়দাদার বাড়িতে তালা ঝুলছে। আশেপাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে হঠাৎ নাকি দিল্লি তে বদলির কারণে ওরা সপরিবারে দিল্লি চলে গেছে। ওরা জানতো শুক্লা দিদি ফিরে আসবে তাও একবারও বড় দাদার বাড়িতে ফোন করে কেউ জানায়নি কিছু। বদলিটা যে হয়েছে সেটা পর্যন্ত জানানো হয়নি।
কোথায় যাবে শুক্লা দিদি! ছোড়দাদার বন্ধু শেখর দা থাকতো গড়িয়াহাট মার্কেটের পিছনে। তার কথা মনে পড়ে শুক্লা দিদির। যদি থাকার একটা ব্যবস্থা হয়। না হলে বড় দাদার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু বড় দাদার ছেলের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি। বাড়ি বড় নয়। তার ঘেরা বারান্দায় মা থাকেন। বড় ঘরটা ছেলের নতুন সংসারের জন্য ছেড়ে দিতে হবে।
সেখানে গিয়ে ওঠাটা সত্যি অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়াবে সবার জন্য। তাই সেখানে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মেজদাদা মুম্বাই য়ে থাকে। জাপানি বৌ তার সঙ্গে নতুন করে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। দিদিরা যে যার শ্বশুর বাড়িতে।
পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে শুক্লা দিদি শেখরদাকে ।
"আপনার সঙ্গে কথা আছে শেখর দা। আমি কি একবার আপনার বাড়িতে আসতে পারি?"
"এসো। কখন আসবে?"
"এখন যদি আসি।"
"এসো।"
শেখর বসুর বাড়িতে গিয়ে শুক্লা দিদি ভেঙে পড়লো। শেখরের স্ত্রী অলকা সব শুনে বললো 'তুমি থেকে যাও যতদিন ইচ্ছে ' ।
'কিন্তু বৌদি আমি বসে বসে খাব? কিছু একটা করতে তো হবে। কী করব বল তো। স্কুল ফাইনালের পর পড়ালেখা করিনি। দিব্যি ছোড়দার ওপর ভরসা করে থেকেছি। এরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে আদৌ বুঝতাম নিজের জন্য আমার কিছু করা দরকার? ওরা একবার জানালো না পর্যন্ত যে ওরা চলে যাচ্ছে। টুলু বুলুও একবার বললো না। বুলুটা আমাকে না জড়িয়ে ধরে ঘুমতে পারেনা। কেমন করে আছে ওরা ? আমি কি মনে রাখার মতো ওদের জন্য কিছুই করিনি? '
হাহুতাশ করে কাটলো কটা দিন। তারপর শেখরদার অফিসের এক ভদ্রলোক বরাভয় সরকার একটা ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে এলো। শুরু করার আগে একটা ট্রেনিং নিতে হবে। কচুরিপানা দিয়ে নানারকমের জিনিস বানানোই হলো এই ট্রেনিং এর বিষয়বস্তু।
ট্রেনিং এর ব্যবস্থা হল। কিন্তু শুক্লা দিদির মা কুসুম পিসিমা মেয়ের অবস্থান নিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। সত্যি এটা কোনো পাকাপাকি ব্যবস্থা তো হল না। এ নিয়ে ছোট ছেলের সঙ্গে ফোনে তুমুল ঝগড়া ঝাটি হয়েছে তাঁর। বদলি কারো রাতারাতি হয়না। জানানোর মতো সময় হয়নি সেটাও হতে পারেনা। যে বোন এতো করেছে তার ছোড়দাদার পরিবারের জন্য কী করে কেউ তাকে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যেতে পারে। শেখর বসু লোক ভালো, আস্তানা দিয়েছেন কিন্তু তা সাময়িক মনে করেই চলা উচিত। কুসুম পিসিমা বড় ছেলে ও মেজ ছেলেকে ডেকে বললেন "তোরা কেউ কিছু বলবি ছোটনকে?"
তাদের একটাই কথা "কী বলব? আমরা তো কিছুই জানিনা"
"কিন্তু তোদের তো নিজের বোন। আমাকেও তোরা বার করে দে বাড়ি থেকে তাহলে।"
শুক্লা দিদির ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই বিডিও অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ শুরু করার পরামর্শ দিল শেখরদা। গ্রামের মেয়েদের দিয়ে কচুরিপানার জিনিস তৈরি করিয়ে বিক্রি করানো তার কাজ।
ধীরে ধীরে নিজেরটুকু চালিয়ে নেওয়ার মতো সঙ্গতি হল শুক্লা দিদির।
শেখরদার বাড়িতে থাকা নিয়ে পরিবারের গঞ্জনা, যে পরিবার তাকে থাকার জায়গা দেয়নি, এবার তার সময় এসেছে জবাব দেওয়ার। গড়িয়াতে এক কামড়ার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলো শুক্লাদিদি। তার কাছে সাহায্য করে গ্রামের মেয়ে কনক, তার সঙ্গে থাকতে শুরু করলো। একটা সময় এলো যখন শুক্লা দিদির বিদেশে যাওয়ার ডাক এলো। সরকারি পয়সায় যাওয়া আসা। সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। এই সাফল্য একদিন খবরের কাগজে প্রকাশিত হল। শুক্লাদিদি বলেছিল সাংবাদিকদের "ছোড়দাদা একপ্রকার পথে না বসালে আর শেখরদার মতো মানুষ পাশে না দাঁড়ালে কোনোদিনই নিজে কিছু করার তাগিদ বোধ করতাম না। জীবন বাই ডিফল্ট আমাকে যা যা দিয়েছিলো আমি সব মেনে সুখে দিন কাটিয়েছিলাম। আমি একা, মহিলা, কিন্তু মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে বাধা নেই আমি শেখর বসুর কাছে কৃতজ্ঞ, হ্যাঁ আমার ছোড়দাদা ও ছোট বৌদির কাছেও ।"
শুক্লা দিদি আরো অনেক বছর পর বিয়ে করেছিল এক অবসরপ্রাপ্ত, বিপত্নীক, মাস্টারমশাইকে। শোনা যায় শুক্লা দিদির সংসার সুখের হয়েছিলো। কচুরিপানার কারবার তখন অন্যকাউকে দিয়ে শুক্লা দিদি রবিবারের সকালে কচুরি ভেজে বরকে খাওয়াতো। একদিন গিয়েছিলাম শুক্লা দিদির বাড়ি, ওর হাতের কচুরি খেতে আর ওর সুখের সংসার প্রত্যক্ষ করতে।