Logo
logo

গল্প / কাহিনী

জলে ভেজা প্রেম

মেয়েটার‌ নাম হেমাল‌ ওঁরাও।বয়স মাত্র কুড়ি।জাতে সাঁওতালি।গায়ের‌ রঙ কালো,তা বলে অমাবস্যার অন্ধকার নয়।কুচকুচে কালো একঢাল চুল,তেল মাখানো,অমসৃণ,রুক্ষ।মায়াবী দুটো বড়ো বড়ো চোখ।সামনের দাঁত দুটো একটু উঁচু।তবে শরীরের বাঁধুনি খুব সুন্দর।দেখে মনে হবে শরীরের প্রত্যকটা ভাঁজ ভগবান অতি যত্ন নিয়ে গড়েছেন।মাথার চুল বিনুনি করে তাতে লাল ফিতে বেঁধে যখন কোমর দুলিয়ে হেমাল যায়,ঝড় ওঠে সাঁওতাল ছোঁড়াগুলোর বুকে।
হেমাল থাকে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে,যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পর্যন্ত কাজ করে না।বিট অফিসার,ফরেস্ট অফিসারের আন্ডারে হেমালের পরিবার ও আরো অনেকে পরিবার গাছ কাটার কাজ করে।এটাই ওদের জীবিকা।পাহাড়ী এলাকার বাঁকে বাঁকে সবুজ।ঝর্নার জলে গা ভিজিয়ে পা ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে হেমাল।ভাবতে থাকে আকাশ পাতাল।
নতুন বিট অফিসার নির্মাল্য সেন।ঝকঝকে তরুণ।বুদ্ধিদীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখে মোটা কাঁচের চশমা।গালে হাল্কা দাঁড়ি,ঠোঁটের ওপর সরু কালো গোঁফ।এই একসপ্তাহ হলো হেমালদের গ্ৰামে এসেছে।আছে অফিসের বাংলোতে।এখনো ঠিক পুরোপুরি মন বসাতে পারেনি কাজে।
এখন বর্ষাকাল।সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পরছে।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে নেই।আজ এমনিও কাজের চাপ কম।শুয়ে শুয়ে জানালার বাইরের মেঘে ঢাকা কালো আকাশটা দেখছিল নির্মাল্য।হঠাৎ দেখে এক তরুণী মাটির রাস্তা ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওপাশের পাহাড়ের দিকটায় যাচ্ছে।মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না।তরুণীর সর্বাঙ্গ ভিজে।পিঠের ওপর এলো চুল।হাঁটার ভঙ্গি ঠিক হরিনীদের মতো‌।দেখতে দেখতে একসময় মিলিয়ে গেল তরুণী।তারপরেও অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল নির্মাল্য।চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল তরুণীর উচ্ছলতা।
কেটে গেছে একমাস।এতোদিনে মোটামুটি সব পরিবারের সাথেই আলাপ হয়ে গেছে নির্মাল্যর।বৃষ্টি ভেজা তরুণীর নামও জানা হয়ে গেছে।হেমাল।খুব সুন্দর নাম।মনে মনে আওড়াতে থাকে নির্মাল্য।
কৌতুহল বশত একদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় হেমালদের ছোট্ট মাটির বাড়িতে।হেমাল তখন দাওয়ায় বসে ওর ছাগল মুংলিকে নিয়ে খুনসুটি করছিল।তাই লক্ষ্য করেনি নির্মাল্যকে।বসতেও বলেনি।নির্মাল্য মুগ্ধ হয়ে দেখছিল হেমালের ঢলঢল মুখ,ভরা যৌবন।হেমালের মা লক্ষী ওঁরাওয়ের নজরে আসে ব্যাপারটা।সঙ্গে সঙ্গে ধমকে ওঠে মেয়েকে,

- ই ছুঁড়ি!তু বসতে দিস লাই নতুন বাবুকে?

চমকে উঠে দুটো মায়াবী চোখ তুলে হেমাল দেখে সামনে নতুন অফছের বাবু।চোখে ইয়া বড়ো চশমা,ঠোঁটে মুচকি হাসি।কি লজ্জা,কি লজ্জা।পরনের কাপড় সামলিয়ে তাড়াতাড়ি মুৃংলিকে ছেড়ে উঠে ঘরে চলে যায় হেমাল।
লক্ষী দাওয়ায় কোথা থেকে একটা ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বসতে দেয় নির্মাল্যকে।

- বুস বাবু,তু বুস।বিটি আমার পাগলিটো আছে।তা তু হঠাৎ মোদের বাড়ি?কিছুক কি হইছে?হেমার বাপ ঠিক‌ আছেক তো?
- আরে মাসি,অত ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই।আসলে এদিকে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি।
- শুনেও শান্তি পেলোম।আরে ই হেমা,নতুন বাবুকে জল বাতাসা দি কেনে।
- যাই মা.....

ঘরের ভেতর থেকে স্টিলের থালায় দুটো বাতাসা আর এক গেলাস জল নিয়ে এসে দাঁড়ায় হেমাল।নির্মাল্যর হাতে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে জিজ্ঞেস করে নির্মাল্য,

- কি নাম তোমার?
- হেমাল ওঁরাও বটে।

উত্তরটা দিয়েই দৌড়ে চলে যায় হেমাল।হাসতে থাকে‌ নির্মাল্য।
এরপর কেটে গেছে আরো তিন মাস।নির্মাল্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এখন।বন্ধুত্বও হয়েছে হেমালের সাথে।লজ্জা ভেঙে হেমাল এখন চশমাবাবুর সঙ্গে অনেকটাই প্রগলভ।হ্যাঁ,এই নামেই হেমাল ডাকে নির্মাল্যকে।হেমালের সবকিছুই খুব ভালো লাগে নির্মাল্যর।মাঝে মাঝেই ওদের দেখা হয় কখনো গাছের ফাঁকে,কখনো ঝর্নার জলে।কোন কারণে হাসতে হাসতে যখন ধনুকের মতো বেঁকে ওঠে হেমাল,সেই মুহুর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী করে রাখে‌ নির্মাল্য।
সেদিন সকাল থেকেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।বাংলোর কেয়ারটেকার রামদীন আজ আসেনি।ওর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা,হাসপাতালে ভর্তি।এদিকে গতরাত থেকেই নির্মাল্যর জ্বর এসেছে।কি খাবে,কিভাবেই বা কাজে যাবে সেসব হুঁশ নির্মাল্যর নেই।বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে‌ নির্মাল্য,মাথায় ভীষন যন্ত্রণা।আকাশের বুক চিরে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।চারিদিকে জল ভর্তি,কাঁদা প্যাচপ্যাচ,মাটির সোঁদা গন্ধ।এরই মধ্যে কে যেন খুব জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।কে এলো এই সময়!রামদীনকে ডাকতে গিয়ে মনে পড়ল রামদীন নেই।নিজেই কোনরকমে অসুস্থ শরীরটাকে টেনে নিয়ে দরজার ছিটকিনি খোলে নির্মাল্য।সামনে হেমাল দাঁড়িয়ে,সর্বাঙ্গ ভিজে চুপচুপে,হাতে টিফিন ক্যারিয়ার।হেমাল জানত রামদীনদাদা আজ নেই,সদর গেছে।তাইতো নিজে হাতে ভাত তরকারি রান্না করে নিয়ে এসেছে চশমাবাবুর জন্য।কিন্তু এ কি অবস্থা চশমাবাবুর!চোখদুটো করমচার মতো লাল।দরজা খুলে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল চশমাবাবু,হেমাল না ধরলে পপাত ধরণীতল।তাড়াতাড়ি টিফিন ক্যারিয়ার পাশে রেখে চশমাবাবুকে খাটে নিয়ে গিয়ে শুয়ে দেয় হেমাল।গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে,হাত দিলে যেন ছ্যাঁকা লাগে।জ্ঞান নেই চশমাবাবুর।তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা জল এনে মাথা ধুয়ে দেয় হেমাল।দিতে থাকে জলপট্টি।বৃষ্টি হয়েই চলেছে,কোন বিরাম নেই।মাঝে একবার চোখ মেলেছিল নির্মাল্য,জ্বরের ওষুধ কোথায় রাখা বলে দিল হেমালকে।তাড়াতাড়ি চশমাবাবুকে জল দিয়ে ওষুধটা খাইয়ে দিল হেমাল।
আধঘন্টার মধ্যে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল নির্মাল্যর।চোখ মেলে তাকালে হেমাল থালায় ভাত তরকারি বেড়ে যত্ন করে খাইয়ে দিল নির্মাল্যকে।তারপর সবটা গুছিয়ে বিকেলে আসবে বলে চলে যেতে গেলে পেছন থেকে বাধা দেয় নির্মাল্য।হেমাল দেখে চশমাবাবুর চোখগুলো কেমন ঘোরলাগা,একটা অদম্য আবেদন!এক ঝটকায় হেমালকে নিজের বুকে মিশিয়ে নেয় নির্মাল্য।থরথর কাঁপতে থাকে হেমাল।কেঁপে ওঠে পুরুষ স্পর্শে।তারপরের একঘন্টা কিভাবে কেটেছে দুজনের কেউই জানে না।বাইরে তুমুল বৃষ্টি,বাজের কড়কড়,জানালা দিয়ে ঝাপটা আসছে বৃষ্টির।দুটো শরীর,দুটো হৃদয়,দুটো আবেগ মিলে মিশে একাকার।

কেটে গেছে কুড়িটা বছর।আজ নির্মাল্য ও হেমালের ছেলে হেমমাল্যর জন্মদিন।আজো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝমিয়ে।কুড়ি বছর আগে বৃষ্টিভেজায় রাতে হেমাল আটকা পড়ে গেছিল ওর চশমাবাবুর কাছে,সারাজীবনের জন্য।অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আজ ওরা সফল দম্পতি।সুখী পরিবারের ক্যানভাসে জলরঙ দিয়ে আঁকা ওদের তিনজনের হাসিমাখা ছবি শোভা পাচ্ছে নির্মাল্যর ড্রয়িংরুমে।ভেসে আসছে জলে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ।

<<Prev1234Next>>

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com