Logo
logo

গল্প / কাহিনী

ঘন শ্রাবণ মেঘের মত রসের ভারে নম্ররত

দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পরে দেশে ফিরে প্রফুল্ল ছোট মামার বাসায় ওঠে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতার মৃত্যুর পর বাবার ভিটেতে আপন বলে আর কেউ নেই। মায়ের কুলেও তিন মামার মধ্যে বড় মামা দুই তিন বছর হল গত হয়েছেন। মেজো মামার তেমন স্মৃতি শক্তি নেই, চোখেও কম দেখেন। মা তো অনেক আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ছোট মামার বাড়িতেই তাকে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিতে হল।
ছোট মামার একমাত্র ছেলে রণদীপ , ডাক নাম রানা।
তাদের এগারো বছর প্রেম বন্ধন এই শ্রাবণে বিবাহ বন্ধনে পরিণত হয়েছে । নতুন দম্পতির বিবাহ আসরে বয়ঃজ্যেষ্ঠ অতিথি প্রফুল্ল । দীর্ঘ দিন পরে দেশে ফিরে প্রফুল্ল আর বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে না ।
শ্রাবণ মেঘের গর্জন , ঘন ঘন কালো মেঘের আনা গোনা দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেটের ধোঁয়া প্রফুল্লর মনে ঝর তুলছে । হঠাৎ নতুন বৌমার ঘর থেকে গান প্রফুল্লর কানে এলো --
" বৃষ্টি বৃষ্টি একি অপরূপ সৃষ্টি এত মিষ্টি মিষ্টি ....
প্রফুল্লর সব যেন ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে --
সেই সেকেন্ড ইয়ার বাংলায় অনার্স পড়া মেয়েটা, এই রকমই শ্রাবণের মেঘ থেকে অঝোরে বৃষ্টি -
কলেজের এক তলার বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মিষ্টি মেয়েটা বাড়ি ফেরার কথা ভাবছে। আমি ও দেরি না করে শান্তিকে মটর সাইকেলে উঠিয়ে ওর বাড়ি পৌঁছে দিতে যেতাম , এই রকম শ্রাবণের বারি ধারায় কত ভিজেছি দুজনায় ।
প্রথমে সে রাজি হয় নি, পরে অগত্যা তাকে রাজি হতে হয় ।
শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ - বৃষ্টি , কলেজ একবারে ফাঁকা।
বেশ কিছুক্ষণ বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় শান্তির বাবা মা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল । দরজায় কলিং বেল টিপতেই শান্তির বাবা দরজা খুলে দিল। শান্তির একমাত্র দাদা বিদেশে এফ. আর. সি. এস . করতে গেছে । আমাকে মেসোমশাই বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেলেন, মাসিমা ছেলের জামা কাপড় হাতে দিয়ে পরতে বললেন তারপর আদা দিয়ে গড়গড়ে এক কাপ চা শান্তি হাতে দিলো । সেই দিন শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ নেমে এসেছিল শান্তির এক ঢাল চুলে। আমাদের মাথায় ছাতা ছিল না, সারাটা রাস্তা অঝোর বর্ষণে ভিজতে ভিজতে ওকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছেছিলাম ।
মায়ের একখানা কালছে নিল শাড়ি পরনে, চুল ভিজে যাওয়ায় পুরো চুল খুলে রেখেছিল ওর মায়ের কথা মতো। মাঝে মাঝেই হাঁচি হচ্ছিল শান্তির । খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল শান্তিকে , মাঝে মাঝেই কালো আকাশে মেঘের বিদ্যুতের ঝলকে মুখমণ্ডলের লাবণ্য দেখার মতো ছিল । আমার মনেও ঝড় উঠেছিল , বৃষ্টি থামতেই আমি বাড়ি ফিরেছিলাম ।
সেদিন থেকেই আমি যে কোনোও বাহানাতে মটর সাইকেল করে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম এখান ওখান বেড়াতে নিয়ে যেতাম । কলেজের বন্ধু বান্ধব সবাই আমাদের ব্যাপারটা অবগত হল । আমরাও অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিলাম ।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে , নিজের ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছাতে গিয়ে সব ওলট পালট হয়ে গেল ।
তখন তো আরএই ফোন ছিলো না, সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটস অ্যাপ ছিলো না। মায়ের লেখা কোনোও চিঠিতে সকল খবর জানতে পারতাম , মায়ের লেখা চিঠিতেই জানতে পেরেছিলাম শান্তির বিবাহের কথা । মায়ের লেখা চিঠিতে এও জেনেছিলাম , মায়ের কাছে ও প্রায়ই আসতো । আমি ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারাই , আমি বিদেশে চলে যাওয়ার পর মা ছোট মামার কাছেই থাকতেন।
হারমোনিয়ামে রিড - এ আঙুল রেখে নতুন বউমা তখনও গান গেয়ে চলেছে । গান থামতেই দরজায় টোকা দিল প্রফুল্ল ।
বড় দা ভাই ? আসুন আসুন বসুন এই চেয়ারটায় বসুন ।
প্রফুল্ল -- তুমি যে গানটি গাইছিলে , আমার বড় চেনা গান ।
নতুন বউমা---- আপনি গান ভালোবাসেন ?
--- খুব ভালোবাসি, এই গানটি তুমি সুন্দর গাইলে । তোমার গলায় সুর , তাল লয় মিলেমিশে আজকের শ্রাবণ মেঘের রূপ ধারণ করেছে । তুমি কার কাছে শিখেছো এই গানটি ?
---- আমার মা শিখিয়েছেন, আমার মা খুব ভালো গান করতেন। মায়ের ভীষণ সুন্দর গানের গলা ছিল মা একটা গার্লস স্কুলের গানের শিক্ষিকা ছিলেন । এখন রিটায়ার করেছেন। বাবা কভিড - ১৯ - এ মারা যাওয়ার পর ঘরে মেয়েদের গান শেখান ।
মনে পড়ে গেলো প্রফুল্লর - শান্তি কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জমিয়ে তুলতো , ওর সুমধুর কণ্ঠের গান আকাশ বাতাসে মিশে অনেক দূর চলে যেতো
---- তোমার মা কেমন আছেন ? তোমার মায়ের কি নাম ?
---- আমার মায়ের নাম শান্তিবালা সরকার ।
---- তোমার বাবার টাইটেল সরকার ?
---- হ্যাঁ ।
স্মৃতিতে এলো মায়ের চিঠিতে জেনে ছিলাম এক ইংরেজির অধ্যাপক নাম প্রবীণ কুমার সরকার । সরকার পরিবারে ওর বিবাহ হইয়েছিল । তুমি সরকার পরিবারের মেয়ে ? তোমার বাবা আধ্যাপক ছিলেন ?
-- হ্যাঁ । আমার বিবাহের সময় বাবা বেঁচে ছিলেন না, মা আমাকে সম্প্রদান করেন । মায়ের সঙ্গে আমার অনেক ছবি আছে ।
এই বলেই নতুন বউ বিবাহের এ্যালবাম প্রফুল্লর হাতে দেয় । শ্রাবণের বিকেল ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া , বৌমা রান্না ঘরের দিকে যায় চায়ের জল বসাতে ।
দুই চোখ ভরে এ্যালবাম দেখে প্রফুল্ল । চোখ যেন বর্ষার ভরা নদী । বৌমার অগোচরে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মোছে।
বৌমা চা নিয়ে এলে শান্তির ফোন নম্বর জানতে ইচ্ছে প্রকাশ করে প্রফুল্ল । তখন ঘোর সন্ধ্যে, শঙ্খ বাজিয়ে , ধূপ জ্বালিয়ে গলায় কাপড় জড়িয়ে সন্ধ্যে দেওয়া শেষ হতেই ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল ---
মেয়ের ফোন ভেবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে --- হ্যাঁ বল কুমু ,
ওদিক থেকে -- আমি কুমু নই, গেস করো আমি কে ?
শান্তি -- কে ? কে ? চেনা গলা কিন্তু গলাটা বেশ ভারী --
কেমন আছো শান্তি ? আমি তোমার মেয়ের হাতের বানানো চা খাচ্ছি ।
--- তুমি ? তুমি আমার মেয়েকে কোথায় পেলে ?
-- ঈশ্বর সবই ঠিক করে রাখেন ।
-- ভালো আছো ?
- - তুমি ?
-- আমি বড় একা! বড় একা !!
-- আমিও তাই !!
বাইরে শ্রাবণের ধারা অঝোরে ঝরে চলেছে ।

<<Prev2345Next>>

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com