Logo
logo

গল্প / কাহিনী

বেদুইন প্রেম ও বর্ষণ

"বিশ্ব যখন নিদ্রামগণ, গগন অন্ধকার,
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার।"

প্রচন্ড দাবদাহের পর সহসা ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে আমার আকাশে। গুরুগুরু মেঘের মাদল বাজতে থাকে, সঙ্গে বিদ্যুতের চমকানি। সৃষ্টিকর্তা আজ খাজুরাহো শিখি। ধরিত্রীর বুকে বাঁশির শরদে তারই অস্তিত্ব। প্রতীক্ষা করে আছে উত্তরায়ণের পরিব্যপ্তি।আকাশের বুক চিরে প্রবল বিদ্যুতের ঝলকানি, কালের বক্ষ ছুঁয়ে সহসা ছড়িয়ে পড়ে হিংসার আগুন। উন্মত্ত সমীরণে এলোমেলো গাছপালা রণাঙ্গনে যেন পথ ভোলা পথিক।
এখনই বৃষ্টি নামবে ক্ষুধায় কাঁপছে দেখ শির-উপশিরা, শুষ্ক ভূমিকে সিঞ্চিত করে সর্বাঙ্গে এঁকে দেবে স্নেহচুম্বন।সারারাত্রি বৃষ্টির নাচন পরিবেশকে মুহূর্তে করে দেয় শীতল। জানলার আরশিতে বিদ্যুতের ঝলক আর জলের আলপনা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন রাস্তাঘাট জলমগ্ন আমি এখন একাদশে, তাই স্কুলে যাওয়া হলনা। যতদুর চোখ যায় জল আর জল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জলের জলছবি দেখতে গিয়ে নজর পড়লো বাড়ির উলটো দিকে এক জলপরীকে। আগে কখনো চোখে পরেনি। সেও আমার মতো জলমগ্ন মাঠঘাট রাস্তা দেখতে বস্ত। প্রথম দর্শনে ভালো- লাগলো। আলাপ করতে ইচ্ছা করছিল খুব। কিন্তু সাহস ছিল না বুকে। যাই হোক বৃষ্টি আস্তে আস্ত কমে গেল। আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হলো।

স্কুল যাবার পথে চোখ যেন কাউকে খুঁজছে মনে হলো। কিন্তু তার দেখা পাইনি আমি। এভাব বেশ কিছুদিন যাবার পর আবার রাস্তার তার দেখা পেলাম। কিছু বলার আগে সে চলে গেল মায়ের সাথে স্কুলের পথে। শুরু হলো অপরিণত প্রেমের উন্মাদনা।
তাকে এক পলক দেখার আশায় হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। প্রতিদিন তার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে শুরু করলাম। সেও আমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল সেটা বুঝতে পারিনি। সাহসে ভর করে একদিন একটা চিঠি তার হাত গুঁজে দিলম। কয়েক দিনের মধ্যে উত্তর পেলাম। নাম তৃষা চক্রবর্তী, নবম শ্রেণী। Phone No -
শুরু হলো কথা বলা। কিন্তু দেখা করার উপায় ছিলনা। স্কুলে বা টিউশানে তার নিত্যসঙ্গী তার মা। আমার পাশ দিয়ে যখন যেত, তখন আমার বুকের ধরফরানি বেড়ে যেত। তৃষার সাথে কথা বললে এত ভালোলাগতো মনে হতো এই পৃথিবীটা কত সুন্দর। এভাবেই গোপনে প্রেম চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস ভালোভাবেই কেটে গেল।
এভাবেই চলছিল দুটো অভিন্ন প্রেমের গোপন প্রেমপর্ব।রাত হলেই শুরু হয় টেলিফোনে কত কথা। শুধু একটিবার দেখা করার প্রবল ইচ্ছার কথা জানায় চম্পক। চম্পককে তৃষা বলে সরবতী পূজতে সে বন্ধুদের সাথে বের হয়। অনেক প্রতীক্ষার পর অবশেষে সরস্বতী পূজা আসে। দুজনেই ব্যাকুল হয়ে থাকে একটু দর্শনের ও সামনাসামনি কথা বলার অপেক্ষায়। পূজার দিন বেলা ১১টার সময় বাড়ীর সামনে দিয়ে বন্ধুদের সাথে তৃষাকে যেতে দেখলাম। পড়নে হলুদ শাড়ী, সুন্দর প্রসাধন আর এলোচুলে ওকে ভীষন ভালো লাগছিল। চম্পক আজ সাদা চুড়িদার পাঞ্জাবীতে তৈরি। বুকের ভেতর উথালপাতাল স্পন্দন, কত গান, কত কবিতা, কত চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছা করছিল। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে এলো। দুজনে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম। চোখে চোখ আর হাতে হাত রেখে বসে রইলাম। যেন কত যুগের সম্পর্কের দন্ধনে আবদ্ধ দুটি হৃদয়। কিছু কথা বলার পর তারা বুঝতে পারে, তাদের ভালোবাসার গভীরতা। আকাশ বাতাস আর বহমান গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, যত বাধা আসুক না কেন তারা কোনোদিন আলাদা হবে না। সময় তার নিজ নিয়মে চলতে থাকে। এবার যেতে হবে। কিন্তু মন মানে না। আবার কবে দেখা হবে? গঙ্গার অবুঝ হাওয়ায় তৃষার খোলা চুল ছড়িয়ে পড়ে মুখে। আলতো হাতে চম্পক তা সরিয়ে দিয়ে চুম্বন করে তার কপালে। আস্তে আস্তে দুজনে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। কিন্তু আমাদের গোপন প্রেম আর গোপন রইলো না। ওর বাড়ীর লোক সব জেনে গেল। ওর ওপর মানসিক অত্যাচার শুরু হলো। আমার কিছুই করার ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলাম। দুজনার কথাবার্তা সব বন্ধ। বাড়ীর বাইরে ওকে আর দেখা যেতনা। আমি অনেক চেষ্টা করতাম ওর সাথে একবার কথা বলার জন্য, কিন্তু কোনো ভাবেই তা সম্ভব হলোনা।
একদিন শুনলাম বাড়ীর সবাই ওর অমতে বিয়ের ব্যবস্থা করছে। অসহায়ের মত সারা রাত ছটফট করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে বিয়ের সানাই বেজে উঠলো। আমি ঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে চোখের জলে ওর বিদায়ের পথ চেয়ে রহলাম। শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে সানাই এর সুর বড়ই বেসুরো মনে হলো। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে দেখি বধূ বেশে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো মুহূর্তে। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আস্তে- আস্তে আঁচলের তলা থেকে একটা ছোট্ট কৌটা বের করে আমায় বললো আমার সিঁথিতে এই সিঁদুরটা পরিয়ে দাও। আমি তোমার, আর কারো হতে পারবোনা।
কিছুক্ষণের মধ্যই বাড়ীতে চিৎকার চেঁচামেচিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। তৃষার বাবা তার মেয়েকে অপহরণের দায়ে পুলিশের হাতে আমাকে তুলে দিল। নির্দোষে আমি গরাদের পিছনে চলে গেলাম। যদিও আমার বাবা প্রকৃত সত্য আদালতে পেশ করে আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করে বেকসুর খালাস করিয়ে আনলেন। কিন্তু ততক্ষণে জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে। বিয়ের পরে তৃষা তার স্বামীকে সব কথা খুলে বলার পর তৃষার স্বামী অতনু তাকে নিয়ে আদালতের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। আমরা সবরকম নিয়মকাণুন মেনে যখন বাইরে এলাম, তখন হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে আমার সথে পরিচয় করলো। আর আমাকে তার বন্ধুর সাথে পরিচয় করাবার নাম করে আমার সামনে যাকে নিয়ে এলো তাকে দেখে আমি অবাক হলাম। অতনুবাবু বললেন ভালোবাসা বড়ই পবিত্র জিনিষ। যা আপনি অর্জন করেছেন আপনার মনের গহন থেকে, তা আমি গ্রহণ করি কিভাবে? আপনার ভালোবাসা তাই আপনার হাতেই তুলে দিলাম। এই কথা বলে তৃষার হাত আমার হাতে সমর্পণ করে চলে গেলেন। শ্রাবণের ধারার মতো তৃষার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি স্বযত্নে তা মুছে দিয়ে তৃষাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আকাশ থেকে বারিধারা ঝড়তে লাগলো।
প্রেমের বর্ষনে দুটি হদর এক হয়ে গেল কোনওএক মন্ত্রবলে।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com