ছোট গল্প : অশরীরীর ঢাক
বীরনগর গ্রামে দূর্গা পূজো বড় আড়ম্বরে হয়। এ বছর পঞ্চাশতম বর্ষে পা দিচ্ছে পুজো। সবাই খুব খুশি। গ্রামের মাঠে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে, কারুকাজ দেখে শহরের লোকেরাও মুগ্ধ।
কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল ষষ্ঠীর আগের রাতে। প্যান্ডেলের চারপাশে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা বলল—রাতে তারা ঢাক বাজতে শুনেছে, অথচ চারপাশে কেউ ছিল না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো কেউ মজা করছে। কিন্তু পরদিনও একই ঘটনা ঘটল—রাত গভীর হলে ভেসে আসে ঢাকের শব্দ, সঙ্গে হাওয়ায় ধূপের গন্ধ।
গ্রামের প্রবীণ মানুষদের মুখে শোনা গেল এক পুরোনো কাহিনি। বহু বছর আগে এখানে এক ঢাকি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ষষ্ঠীর রাতে। তখন থেকে নাকি প্রতি বছর পূজোর আগে গভীর রাতে শোনা যায় তার ঢাকের শব্দ—যেন সে এখনও মাকে বাজিয়ে স্বাগত জানায়।
শুভম, গ্রামের এক কিশোর, ভয় পায়নি। বরং সে চাইল সত্যিটা জানবে। নবমীর রাতে সে বন্ধুদের নিয়ে লুকিয়ে বসে রইল মাঠের ধারে। রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই—হঠাৎ কানে এলো ঢাকের আওয়াজ! ছন্দ একেবারে নিখুঁত। আলো-আঁধারিতে দেখা গেল ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, যেন এক অদৃশ্য হাত ঢাক বাজাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য ছেলেরা ভয়ে স্থির হয়ে গেল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—সেই ঢাকের তালে যেন প্রতিমার চোখে প্রাণ জেগে উঠল। সবাই পরে বলল, এ কারণেই বীরনগরের পূজোর প্রতিমা সবসময় এত জীবন্ত লাগে, যেন সত্যিই মা এসেছেন।
দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জনের সময় গ্রামের মানুষ একসঙ্গে “বলো দুর্গা মাইকি জয়!” বলে স্লোগান দিচ্ছিল। শুভম তখন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতিমা যখন জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল, তখনই হঠাৎ দূরে ভেসে এলো শেষবারের মতো ঢাকের শব্দ—গভীর, বিষণ্ণ, কিন্তু গর্বিত।
সেই শব্দ যেন বিদায় জানাল মা-কে এবং গ্রামের মানুষকে আশীর্বাদ করল। মুহূর্তেই শব্দ থেমে গেল, নদীর জলে শুধু প্রতিমার প্রতিফলন দুলে উঠল।
শুভম বুঝল—কোনও ভয় নেই, অশরীরীরাও মায়ের ভক্ত। আর হয়তো সেই ঢাকি আত্মা প্রতি বছর ফিরে আসে শুধু একটাই কারণে—মায়ের আগমনী আর বিদায়কে সুরের মাধ্যমে অমর করে রাখতে।
সেই থেকে বীরনগরের মানুষ ভয় নয়, বরং গর্ব অনুভব করে যখন গভীর রাতে অশরীরীর ঢাক বাজে। কারণ তারা জানে—এটা আসলে এক অনন্ত ভক্তির সুর।