গল্প - উৎসবের আড়ালে
পুজোর আগের রাত।
শহরটা আলোয় ঝলমল করছে, প্যান্ডেলগুলো সেজে উঠেছে নতুন রঙে, আর বাজারের হুলস্থুলে মনে হয় এইবার উৎসব যেন একটু বেশি উজ্জ্বল। সবার মুখে হাসি, হাতে ব্যস্ততা।
তবু মধুরার মনটা যেন একটু ভারাক্রান্ত।
এই আনন্দের পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক সংগ্রাম, অনেক অদৃশ্য ব্যথা। ছোটবেলা থেকেই তার জীবনের সঙ্গী ছিল লেখালেখি — উৎসবের রঙিন মুখোশের আড়ালে সে জানে জীবনটা কতটা জটিল।
এই বছর তার লেখা পেয়েছে ‘উৎসবের সেরা লেখিকা সম্মাননা ২০২৫’।
বাইরে সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানায়, ছবি তোলে, কিন্তু ঘরের অন্ধকারে কেউ সেই অর্জনটাকে বিশ্বাস করতে চায় না।
“পুরস্কার তো টাকা দিয়ে নেয়া হয়।”
“নিজের লোক না থাকলে কিছু হয় না।”
মধুরার মুখে হাসি আসে না।
যখন সে ছোটবেলায় লেখার বানান ভুল করত, ছন্দ মিলত না, তখনও তার লেখা পড়ে সবাই উৎসাহ দিত। আজ, যখন সে সত্যি ভালো লেখে, তখন সন্দেহের চোখই পায়।
স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ছোটবেলার সেই বিকেলগুলো।
বাবার সঙ্গে বসে লেখা শিখত মধুরা।
বাবা বলত, “তুই যা লিখিস, সেটা মন ছুঁয়ে যায়।”
স্কুলের বন্ধুরা ছিল তার প্রথম পাঠক।
“আজকে নতুন কী লিখলি?”
“আমাদেরও শোনাবি তো?”
বাবার পুরনো খাতা, স্কুলের বইয়ের পাশে লুকোনো সে লেখা, সবই ছিল তার গর্ব।
বাবা কখনো তাকে ছোট করত না, বরং লেখাগুলো ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখত।
কিন্তু এখন?
আজ যখন ভালো রান্না করে, কেউ বলে, “দোকান থেকে এনেছিস বুঝি?”
আজ যখন তার কবিতা ছাপা হয়, কেউ মুখে বলে না কিছু, কিন্তু চোখেই বলে যায়, “নিজেকে বড় ভাবিস?”
নিজের ভালোটা নিজেই বললে ‘অহংকার’ বলে ফেলে কেউ।
মধুরা জানে, এই অস্বীকৃতিই তার শক্তি।
যে অবহেলা তাকে শিখিয়েছে কিভাবে শব্দ দিয়ে কান্না লিখতে হয়।
এই পরিবারের টানাপোড়েন, এই সমাজের বিচ্ছিন্নতা — এগুলো তার গল্পের মূল বিষয়।
বাবার কথা মনে পড়ে:
“তোর মনের লেখা কোথাও আটকে থাকে না, ও তো উড়ে চলে যায়, ঠিক যেখানে পৌঁছতে চায়।”
এক চিঠি আকাশে
রাত গড়িয়ে যায়,
এক পৃষ্ঠা খাতা নিয়ে বসে চিঠি লেখে, বাবার উদ্দেশ্যে।
বাবা,
তুমি বলেছিলে, “তুই যা লিখিস, সেটা মন ছুঁয়ে যায়।”
আজ আমি একটা পুরস্কার পেয়েছি।
সবাই বিশ্বাস করতে চায় না — কিন্তু আমি নিজে করে দেখিয়েছি।
আজ তোমার সেই হাসিটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, যা শুধু আমি কিছু লিখলে দেখতে পেতাম।
জানি, তুমি দূরে আছো, কিন্তু এই চিঠিটা আকাশে ছেড়ে দিলে তুমি ঠিক পেয়ে যাবে।
তোমার মেয়ে,
মধুরা
চিঠিটা ভাঁজ করে, হাত দিয়ে ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে।
চিঠিটা হাওয়ায় ভেসে চলে, একটা অদৃশ্য ঠিকানার দিকে।
মধুরা জানে, তা পৌঁছে যাবে।
কারণ বাবা বলেছিল —
“তোর মনের লেখা কোথাও আটকে থাকে না।”
আজ মধুরা জানে, তার জীবনের প্রতিটি উৎসব, প্রতিটি লড়াই, প্রতিটি লেখা —
একটা করে চিঠি, যেগুলো সে পাঠায় হারিয়ে যাওয়া শক্তির কাছে।
_সে আর একা নয়, সে তার নিজের গল্পের নায়িকা।