Logo
logo

সাহিত্য / কবিতা

ছোট গল্প : নীলাম্বরী

শরতের নীল আকাশের গায়ে সাদা তুলো তুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সকাল থেকেই । মন আজ বড্ড বেশি ফুরফুরে। শনিবার,আজ আর দুপুরে ঘরে নয়, সাহেবকে অফিস থেকে টেনে নিয়ে সোজা অফিস পাড়ায় স্ট্রীটলাঞ্চ সারবো।
জমে যাবে বর্ষার বিদায়লগন।আজকের রোদে কেমন পুজো পুজো গন্ধ।দারুন হবে ব্যাপারটা ভেবেই সাহেবকে ফোন করলাম ।
------ হ্যালো
------- হুম বলো, কি ব্যাপার? তাড়াতাড়ি বলো যা বলার আছে, কাজে আছি তো ---
------- উফফ! বলছি শোন না আজ শনিবার তুমি আসছো তো দুপুরে?
ওপারের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললাম
------- আজ আমিই আসছি বুঝেছো, তুমি বড় গেটটার সামনে থেকো।
----- বেশ,তবে তাই হোক।

----আরিব্বাস!আজ তো দেখছি ভাগ্য সুপ্রসন্ন । এক ফোনেই এক-লাখি সম্মতি! কিন্তু ব্যাপারটা কি?
এই হচ্ছে আমার এক দোষ,এক কথায় কাজ হয়ে গেলেই কেমন যেন সন্ধ-সন্ধ গন্ধ পাই।তারপর বাবু বলেন কিনা
---–‘ নো সালোয়ার,নো স্কার্ট, এক্কেবারে নীলশাড়িতে এসো’।

আমি তো একেবারে একলাফে চল্লিশ থেকে চব্বিশে নেমে আলমারি তন্নতন্ন করে ফেলেছি। বহু নীলশাড়ি বহুবার পরেছি,আজ কুহুদির দেওয়া নীলশাড়িটাই ভেঙ্গে পরি। শাড়িটা টেনে বের করে ম্যাচিং ব্লাউজও পেয়ে গেলাম। সেবার কুহুদি বিবাহবার্ষিকীতে এই শাড়িটা আমাকে দিয়েছিল। কুহুদির হাসি হাসি মুখটা মনে পড়ে গেল।
ফিরে এসে আজ সন্ধায় কুহুদিকে একটা ফোন করবো, কি যে খুসি হবে কুহুদি।
সব একদম মনোমত ঠিকঠাক! বরং একটু বেশিই ঠিকঠাক আজ যেন। কি একটা ভাবতে ভাবতে বাবার পাঠানো পুজোর বাজারের টাকা'টা টুক্ করে ভরে নিলাম পার্সে, যদি বাবু খোশমেজাজে থাকেন তবে একবার নিউমার্কেট'টা চক্কর দেবো। ---উমম্ আজ কত তারিখ যেন? ওয়াও! আজ তো মাসের প্রথম সপ্তাহ ! আর বলতে হবে না।
মনকে বললাম -----
“ওরে মন ধরে নে আজ তোর কাজ হয়েই গেছে”।সাহেব মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজার মতো থাকে ভেবেই হাসি পেয়ে গেল। ফাঁকা বাড়িতে গুনগুন করতে করতে সব গুছিয়ে সাজুগুজু করে দুগ্গা দুগ্গা করে বেরোলাম।
মেট্রো ধরতে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন টিকিটের। আমার অবশ্য চিন্তা নেই,এই দিকে আমার সাহেব খুব স্মার্ট,আমার জন্য স্মার্ট কার্ডের ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। জানে তো খামখেয়ালী উড়নচণ্ডীকে । হয়তো এমন দিন হলো খুব আর্জেন্ট ডাক,
'অফিসে একবার আসতে হবে তোমাকে'।
যদি দেখি মেট্রোতে বিরাট লাইন মানে এই আজকের মতো তবে পিছুটান মেরে সোজা বাড়ী গিয়ে ঘুম,আর যাবই না!তাই এই ব্যাবস্থা।
ভিড় ঠেলে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠেই বসে দেখি ওমা সখের আংটিটা পরিনি। ভাল্লাগে না আজকেই তো সাহেবের সেটি দেখার সময়। যাইহোক যথা সময়ে নামলাম।
কিন্তু একি? মাত্র কয়েকটা ষ্টেশন পেরোতেই সন্ধ্যে হয়ে গেলো কেন? হঠাৎ করে স্ট্রীট লাইট গুলোও জ্বলে গেল। মোবাইলে সময় দেখার আগেই ঝমঝম–গুড়গুড়। এক নিমেষে ভিজে একসা। এক-পা,দু-পা করে এগিয়ে গেলাম অফিসের মেইন গেটের সামনে রাধাচূড়া গাছটার নীচে ।
ঘড়িতে তখন দুপুর পৌনে দুটো! অন্ধকারটা কেটে গেল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই, কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি।ছাতা বের করতে গিয়ে এমন হাওয়ার দাপট যে কে-সি পালের তিনটে শিক্ মচকে গেল, মনে হল আমার পাঁজর ভেঙ্গে খান খান।আহা সেবার অনিরুদ্ধ কত আদর করে উপহার দিয়েছিল!
যাতে দুজনে একছাতার তলায় চিরকাল -------।
যত কান্না পাচ্ছে তত খিদে পেয়েছে। আজ মনে এত সুখ জেগেছিল যে টিফিন টুকুও করিনি।
রাস্তায় প্রচুর লোক, হাজার গণ্ডা চোখ আমাকে গিলে খাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া হাউস আমার এমন অবস্থা দেখে ভেংচি কাটছে যেন। আমার সাহেবের তবু পাত্তা নেই। দুটো বেজে গেছে,ফোন করলাম, রবীন্দ্রগান বেজে বেজে ফোন ক্লান্ত হয়ে গেল। আচ্ছা সে তো জানে আমি আসবো তবু কেন যে বেরচ্ছে না, মনে মনে বিরক্তিতে ফেটে পড়ছি আর কাঁহাতক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবো? হাজার চোখের চাহনি এড়িয়ে, নিজের দিকে যখন তাকাই দেখি আজ সুযোগ পেয়ে কুহুদির দেওয়া নীলশাড়িও আমায় রঙ দেখাচ্ছে ।
সারা শরীর নীল, সব রঙ পা দিয়ে গড়িয়ে আজ ধর্মতলা চত্বর নীলে নীল হবে নাকি কে বাবা।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না,সামনে একটা চা- কফির দোকানে গেলাম । এককাপ কফি চাইলাম। কফি মেশিন থেকে কফি দেওয়া দেখতে দেখতে শ্যামের বাঁশী বেজে উঠলো ব্যাগের ভেতর;
“ বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যাঁয়...’’ । এই তো সাহেবের ফোন ' তাড়াতাড়ি করে ফোন ধরি,না'কি কফি ধরি? ভাবতে ভাবতেই কফির কাপ আমার গায়েই ... ব্যাস !
উফফফফফ্ করে উঠতেই দেখি আমার মহাপ্রভু আমার সম্মুখে। সাদা শার্টে নীল ডেনিম । আর আমি? আমি ততক্ষণে এঁদো পুকুর থেকে তুলে আনা পচা নীলশালুক। লতপত করছি আর ভেবে মরছি আমি এখন কাঁদবো, নাকি অফিসচত্বর কাঁপিয়ে ঝগড়া করবো, নাকি শুধুই চিৎকার করবো? বুঝে গেলাম 'এই মুহূর্তে কোনো কিছু করেই সুখ নাই।' সাহেব আমাকে দুহাতে ধরে একটা প্লাস্টিকের পেতে রাখা টুলে বসালো।পকেট থেকে চারভাঁজ করা পরিপাটি রুমাল এগিয়ে দিয়ে আরও দুটো কফির অর্ডার দিল। আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দ্যাখে ট্যাক্সি মেলে কিনা।
অবশেষে ট্যাক্সি পেলে, আমার ব্যাগ, ভাঙ্গা ছাতা, চুপসে যাওয়া এই নীলরঙের আমিটা'কে গাড়ীতে তুলে সাহেব সোজা বাড়ির দিকে। সারা রাস্তা গাড়ীতে কোনও শব্দ নেই, যেন এক কঠিন নীরবতার কাছে আমরা ব্রত উদযাপন করছি। ফ্ল্যাটের সামনে নেমে সাহেব যখন ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে দেখি তার শখের সাদা শার্টে নীলশাড়ির নীল নীল মেঘ ঢলোঢলো কাঁচা অঙ্গের লাবণী ~~
ততক্ষনে বৃষ্টিও ধরে গেছে বেশ। তুলো তুলো মেঘ আবার ভেসে বেড়াচ্ছে।
দুপুরে ‘স্ট্রীটলাঞ্চের’ বদলে বাড়িতেই ‘টোস্টলাঞ্চ’সেরে মুঠোফোনটা নিয়ে গড়াগড়ি খেলাম সারা বিকেল, রাতে কী রান্না করবো ভাবতে ভাবতেই আনন্দ এলো সারামনজুড়ে,
আবার বেরোলে কেমন হয়।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com