রবীন্দ্রনাথের অনুভবে প্রকৃতির প্রতিধ্বনি
"মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে, নিঃসীম শূন্যে,...."
অনুমিতার মনের কোণে কদিন ধরে এই গানটি ঘুরেফিরে বারবার আসছে। অনুমিতার মন ছুটি ছুটি করছে, কলকাতার ব্যস্ততা,কোলাহল, আর নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে সে কোথাও ছুটে যেতে চাইছে, মন কিছুদিনের জন্য ছুটি চাইছে তার।
' শান্তিনিকেতন!' হ্যাঁ, এই জায়গাটি তার বরাবরের পছন্দের জায়গা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন তার একাধারে প্রিয় কবি, ঠিক শান্তিনিকেতন ও অনুমিতার ছুটি কাটাবার প্রিয় জায়গা। কি জানি কেন, এই জায়গাটিতে সে গেলে হারিয়ে যায়, তার মন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, প্রকৃতি, পরিবেশকে নিয়ে কোথাও একটা হারিয়ে যায় সে, যে হারিয়ে যাওয়া বেশ ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে তার মনকে হালকা করে, ভারমুক্ত করে।
তাই অনুমিতা আর দেরি করল না। সবকিছু তোড়জোড় করে কিছুদিনের ছুটি কাটাতে রওনা হয়ে পড়ল তার প্রিয় কবিকে মনের সাথে বেঁধে নিয়ে প্রিয় জায়গার উদ্দেশ্যে।
আকাশে হালকা ধূসর মেঘের চলাচল, সূর্যের আলো সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলছে, যেন প্রকৃতি নিজের রং বদলাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এমনই এক দুপুরে অনুমিতা এসে পৌঁছল শান্তিনিকেতনে, কবিগুরুর পবিত্র আশ্রম -- তার প্রিয় জায়গায়।
অনুমিতা একজন অধ্যাপিকা। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে তার সাহিত্যে এম.এ, ও পরবর্তীকালে পিএইচডি করা। কিন্তু, আজ এই অধ্যাপিকা অনূমিতা জীবনের টানাপোড়েন, সম্পর্কের জটিলতা, আর নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নবানে বিদ্ধ, জর্জরিত। তাই, এসকল থেকে মুক্তি পেতে মনকে নতুন করে সাজিয়ে নিতে সে আবার ফিরে এসেছে সেই চিরাচরিত শান্তির আশ্রয়ে --- প্রকৃতি ও কবিতার জগতে।
আশ্রমে প্রবেশ করতেই তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া বয়ে গেল। ছোট ছোট বাড়ি, লাল মাটির পথ, ছায়া ঘেরা বৃক্ষ, আর পাখির কলকাকলি যেন কবিতার ছন্দে বাঁধা। আগে থেকে বুক করে রাখা গেস্ট হাউসে উঠল অনুমিতা। এখানে এলে তার যেন সব ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। তাই আর বিশ্রাম না নিয়ে সে গেস্ট হাউসের জানলার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। বাইরে বকুল গাছে নিচে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে ছবি আঁকছে আপনমনে। তাদের দেখেই তার মনে একটি কবিতার লাইন উঁকি দিল ;
" মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।"
এই রবীন্দ্রনাথ নামক লোকটি কেমন করে যেন নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে, এক সহজ সরল ছন্দে। অনুমিতাব চোখে জল এসে পড়ল হঠাৎ, আবেগকে সে লুকিয়ে রাখতে পারল না, আজও এমন করে কেউ বলতে পারল না, রবীন্দ্রনাথ একজনই।
বিকেলে সে আশ্রম চত্বরে হাঁটতে বের হল ।ছাতিমতলা, উপাসনা গৃহ --- সবকিছু পার হয়ে চলেছে একের পর এক, মন্ত্র-মুগ্ধের মত। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর তাকে সচকিত করল --" আপনি কি এখানে নতুন?" অনুমিতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, এক বৃদ্ধ,শান্ত সৌম্য চেহারা,সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত, চোখে কালো প্রেমের চশমা,-- "আমি সৌম্য চক্রবর্তী, আশ্রমের পাঠভবনের শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হয়ে নতুন এসেছি এই শান্তিনিকেতনে"।
"আমি অনুমিতা ঘটক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকা। কয়েকটা দিন কবিগুরু কে মনের সাথে জড়িয়ে কবিগুরুর আশ্রমে ছুটি কাটাতে এসেছি।"
মৃদু হাসলেন সৌম্যবাবু,"ঠিক জায়গায় এসেছেন ম্যাডাম। এখানে প্রকৃতি এক অনুভব শক্তি, একে অনুভব না করে থাকা যায় না। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, তিনি তো প্রকৃতির দূত, প্রকৃতির কবি। ওনার লেখা কবিতায় তা ধরা পড়ে বারবার। প্রকৃতি ওঁর কাছে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, এক অনুভূতি, একটি জীবন্ত সত্ত্বা। তাঁর লেখা ঐ কবিতাটি, "ঢেউয়ের গায়ে ঢেউ গুলো সব গড়ায় ফুলে ফুলে,
পূবের চরে কাশের মাথা উঠছে দুলে দুলে,
ঈশান কোণে উড়তি বালি আকাশখানা ছেয়ে,
হু হু করে আসছে ছুটে ধেয়ে।".... "ঝড়" কবিতায় প্রকৃতি, এ তো তাঁরই ভাষা।"
অনুমিতা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল কথাগুলি। সত্যিই তো, এতদিন ধরে কবিতাগুলো পড়ছে বটে সে, কিন্তু আজ আবার নতুন করে তার প্রকৃত অর্থ ধরা পড়ল তার কাছে। প্রকৃতি যেন পটভূমি নয়, চরিত্র,যেখানে মেঘ আছে, বৃষ্টি আছে, গাছ আছে, পাখিদের কলরব আছে--- তারা যেন সবাই কবির আত্মীয়। সৌম্যবাবু আর অনুমিতা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলেন বকুল তলার কাছে। চারিদিকে বেশ একটা নিস্তব্ধ, নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক হঠাৎ হঠাৎ করে উচ্চকণ্ঠে জেগে উঠছে।
ঝিরঝিরে হাওয়া কে আলতো করে জড়িয়ে গাছের পাতা কেঁপে কেঁপে উঠছে, এই সময়ই অনুমিতার মনে গেয়ে উঠল," যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।"
এই আওয়াজ তার চেনা, কিন্তু আজ সে ধরা পড়েছে একাকিত্বের মাঝে, মনে হচ্ছে এই চলার ডাক তার নিজের, একান্তই নিজের চলার ডাক। ব্যক্তিগত জীবন তার ভেঙেচুরে চূর্ণ-বিচূর্ণ।স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, কর্মস্থলের মানসিক চাপ, বন্ধুত্বের ভাঙন, সবকিছুর মাঝে লড়াই করতে করতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু আজ, তার প্রিয় কবি তাকে এই প্রকৃতির মাঝে দাঁড় করিয়েছেন, নিজের ভেতরের সত্ত্বাকে জাগ্রত করতে তাঁর হাতটা তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পরদিন সকালে সে আবার নতুন করে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করল সবুজে মোড়া খোলা প্রান্তর, মাঝখানে একটানা বালি- মাটি দিয়ে তৈরি পথ, দূরে গরু চড়ছে, শিশুরা খেলছে, পাখির ডাক, বাতাসের মৃদু গতি, সবকিছু মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতি, এক অদ্ভুত রসায়নের মাঝে। আজ তার মনে হল, শব্দেরা তাকে আবার নতুন করে ছুঁতে চাইছে। অনেক দিনের না লেখা ডায়েরির পাতা খুলে সে লিখে রাখল রবীন্দ্রনাথের সেই গানের লাইন,---
'এই কথা বলিতে আমার লাজ হয়, আমি এ কথা গোপনে গোপনে রাখিব জেনো"।
প্রকৃতির সঙ্গে তার এই গোপন সংলাপ থাক আজ শুধুই কবিগুরু আর তার মাঝে এক গোপনবন্ধ হয়েই।
বিকেলে আবার দেখা সৌম্যকান্তি চেহারার সৌম্য বাবুর সাথে।
"জানেন ম্যাডাম, রবীন্দ্রনাথের "সোনার তরী", "গীতাঞ্জলি", "প্রকৃতির প্রতি" তে শুধু ভাব নয়, এক গভীর দর্শন উঠে এসেছে, প্রকৃতি তাঁর কাছে এক ভালোবাসা।
অনুমিতা মৃদুস্বরে বলে, "বুঝতে পারছি, অনুভব করতে পারছি।"
"রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র পড়ার বিষয় নয়, তিনি উপলব্ধির বিষয়, যা আসে প্রকৃতির হাত ধরেই, প্রকৃতির মাঝে"। সৌম্যবাবু বলে ওঠেন।
এবার কলকাতার ভিড়ে আবার একাকার হওয়ার পালা, মন ভারাক্রান্ত, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। ফিরতে হবে, কিন্তু অনুমিতা ফিরছে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিকে জড়িয়ে, তাঁর গান, কবিতাকে সঙ্গী করে। গুনগুন স্বরে গেয়ে ওঠে,--- " আবার এল যে সন্ধ্যা, প্রিয় ভুলে গেয়ো যত যন্ত্রণা----"
আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে--- লালচে আভা ছড়িয়ে প্রকৃতির বুকে। অনূমিতার চোখে জল, মন এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরপুর, প্রকৃতি আর কবিগুরুকে তার হৃদয়ের সাথে মালা গেঁথে সে পা বাড়ালো নিজের দুনিয়াতে।