মানব অনুভবে ও চেতনার বিশ্বকবি
বাংলার ১২৬৮ সাল, ইংরেজির ১৯৬১ সাল, বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখ,মে মাসের ৮ / ৯ তারিখ, এক মহান পুরুষ বিচিত্রতা এবং বহুমুখিতা যার অপর নাম, সেই আমাদের সকলের প্রিয় ও প্রাণের কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর জন্মগ্রহণের শুভক্ষণ এই দিনটি।
কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা সুন্দরী দেবীর কোল আলো করে এসেছিলেন তাঁদের ১৪ তম সন্তান।
ছোট থেকেই ভৃত্যদের দেখভালের লালিত পালিত তিনি। বাবা চাকরি সূত্রে বাইরে আর তিনি ছিলেন শৈশবেই মাতৃহারা। তাই একটি গন্ডির মধ্যে ই ছিল তার আনাগোনা।
জানালা দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য তাকে মোহিত করত। পড়াশুনায় তেমন মন ছিলনা, স্কুলের বাঁধা ধরা পড়াশুনার গন্ডি ছিল তাঁর একদম অপছন্দের।
প্রকৃতির হাতছানি তিনি পেতেন সর্বদা, তিনি ছিলেন এক প্রকৃতি প্রেমী। গৃহশিক্ষকের কাছেই তাঁর লেখাপড়া, কিন্তু পরে অবশ্য তিনি কিছু নামী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
ছোট থেকেই মাত্র আট বছর বয়স থেকে তাঁর লেখা শুরু। আবেগী, দরিদ্রদের প্রতি দয়ালু এই কবি মহাকাব্য ছাড়া সাহিত্যের এমন কোন অংশ নেই যেখানে তিনি দ্যুতি ছড়ান নি।
কবিতা, নাটক, উপন্যাস,ছোটগল্প, প্রবন্ধ,ভ্রমন ,কাহিনী সংগীত, সহ যেখানেই কবিগুরুর স্পর্শ পড়েছে সেখানেই সোনা ফলেছে। চিত্রশিল্পী হিসেবে ও তিনি ছিলেন অনন্য, তবে তাঁর রচিত কবিতা ও গান নিয়েই আমরা বেশি আলোচনা করে থাকি তাই তার চিত্রশিল্প অনেক সময় রয়ে যায় আমাদের আলোচনার বাইরে।
তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু ছোট ছোট কবিতা লেখনীর মধ্যে দিয়ে।
তাঁর সাহিত্যই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে।
তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন।
তিনিই বুঝে ছিলেন প্রকৃতিকে রক্ষা করতে না পারলে, পরিবেশ কে বাঁচাতে না পারলে মাটির সাথে এই আমাদের ( মানুষদের) সম্পর্ক টিকবে না। তাঁর এই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা চিন্তাভাবনা, তাঁর জীবনদর্শন তাঁর মূল্যবোধ , মানসিকতা আর কোন বাঙালির জীবনে ছিল কিনা মনে হয়না।
" তোমার তুলনা তুমি তাই তো তোমায় নমি"
গানটির লাইনের মত কবির তুলনা কবি নিজেই।
তিনি সাহিত্য ও সংগীতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে ছিলেন। একটু একটু করে তিনি কবি থেকে বিশ্বকবি, কবিগুরু, অভিধায় অভিষিক্ত সকলের নয়নে। তাঁর আসল পদবী কুশারী ( পিরালী ব্রাহ্মণ, ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশজাত), কিন্তু তিনি সকলের কাছে ঠাকুর (উপাধি) হিসেবেই পরিচিত, কতজন তার আসল পদবী জানে? প্রতিটি বাঙালীর জীবন রবীন্দ্রনাথ কে বাদ দিয়ে ভাবা যায়না। কারণ একটাই , তাঁকে বাদ দিয়ে বাঙালী হওয়া যায়না। প্রকৃত বাঙালী মানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কে গ্রহণ করতেই হবে। বাংলা সাহিত্যে এমন কোন শাখা নেই, যেখানে তাঁর আদুরে ছোঁয়া নেই। প্রতিটি বাঙালী কে মননশীল ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ করতে ওনার বিকল্প নেই। প্রতিটি বাঙালীর জীবনে ওঁনার প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।
ওঁনার সুদূর প্রসারী চিন্তা ভাবনা তাঁকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করে। জন্ম থেকে মৃত্যু, আর মৃত্যু থেকে জন্ম - এই যে আসা - যাওয়া, বিরহ, আনন্দ, বিষাদ, আত্মপ্রকাশ সব কিছুতেই আমাদের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয় কবি। এমন কি বাঙালীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা এবং উপমহাদেশে প্রথা সমবায় তথা কৃষি ব্যাঙ্কের প্রসারের ভাবনা এবং ক্ষুদ্র ঋণের কথা তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া কেবল শিল্প ও সাহিত্য দিয়ে কখনও মানব জাতির মঙ্গল সম্ভব নয়। আর এখানেই তিনি অনন্য এক মহীরুহে পরিণত।
তিনি সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দান করেন, যা তুলনাহীন। সকল ক্ষেত্রেই তাঁর আধুনিকতার ছোঁয়া। সাহিত্যকে তিনি বাংলার থেকে আরও দূরে নিয়ে যেতে পারতেন, তিনি বহুবার বৃহৎ বিশ্বের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, যেতে পারেননি যেতে কারণ সব সময় তাঁকে স্বস্তি দিয়েছে তাঁর বাংলা।
তাই তো তিনি আমাদের বলেছিলেন----------------
" মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক, আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়"।
তিনি কি, তা তাঁর "বিশ্বপরিচয়" বইটি পাঠ করলেই সহজে অনুমেয়। আমাদের মানসিক দ্বন্দের ও টানাপোড়েনের অবসান তাঁরই পাঠে আবশ্যকতা লাভ করে। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্যের সব শাখার মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে আলোর দীপশিখা দান করে যাবেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনায় তিনি ছিলেন একজন অগ্ৰগামী চিন্তার মানুষ। তিনি নিরন্তর প্রকৃতি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অন্বেষণ করেছেন আমাদের পৃথিবী। প্রকৃতির সুরক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃতি পর্যায় নিয়ে বিভিন্ন গান ও কবিতা রচনা করেছেন। প্রেম, স্বদেশী, পূজা প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে তিনি তাঁর রচনার সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃত ভাবেই লেখেননি, তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তার বাস্তব রূপও দেখিয়েছেন।
তাঁর বিশুদ্ধ পানি ও গণস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা তাঁর পরিবেশের প্রতি ভাবনা গুলো স্মরণ করিয়ে দেয় "দুই পাখি" এই কবিতার মাধ্যমে তিনি একটি পাখির করুণ অবস্থা তুলে ধরেন। ফল "সঞ্চয়িতা" কবিতায় তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন যে প্রাকৃতিক কর্মকান্ডে কারওরই হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয়। বাঙালির সমগ্র স্থান জুড়ে কবির সদর্প অবস্থান।
২৫ শে বৈশাখ এই মহান কবির জন্মদিন, তাঁকে এই দিনটিতে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়। বিশ্বের অনুবীক্ষন ও মানবপ্রেম রবীন্দ্রমানসের মৌলিক পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের গড়া অবৈতনিক স্কুল, দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, কুঠির শিল্পের প্রসঙ্গে বিনা সুদে কৃষি ঋণ ব্যবস্থা তার অবদান। মানুষ কে আপন করে দেখার মানসিকতাই তাকে সমাজ উন্নয়নের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ অনূভুত একজন রোমান্টিক কবি। কবিকে বাংলা দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের তথা প্রকৃত আধুনিক ছোট গল্পকারের মর্যাদা। তাঁর সাহিত্যের বিশালতা ও গভীরতায় বাঙালী জাতি ঋদ্ধ। তিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে । তাঁর নোবেল জয় এবং পরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নোবেল ত্যাগ, কবির দুই বাংলার জাতীয় গান তাকে ভুলতে দেবেনা কখনো।
তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনাই কবিকে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করে। তিনি মন্ত্র বর্জিত হয়ে সহজ ভক্তির আলোকে দেবতাকে পেতে চেয়েছেন। ওঁনার
গীতাঞ্জলির ১০৭ সংখ্যক কবিতায় কবি সর্বহারাদের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন। কবির চিন্তার সৌন্দর্য্য ছিল এতটাই যে তিনি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অভ্যন্তরে তাঁর চাওয়া গুলোকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন গভীর এক আবেদনের মাধ্যমে। আর সে কারণেই তিনি আজও রয়েছেন আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।
আমাদের প্রাণের, জীবনের, চেতনার, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী, সুর আমাদের হৃদয়ে দোল দেয়, দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। বিভিন্ন সংগঠন রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন। তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টি আজকের সমাজে ভীষন প্রাসঙ্গিক। যা সঠিক পথের দীশা জোগায়, আত্মগ্লানির হাত থেকে মুক্তি দেয়। বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেমিক কবি তো অনেক আছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতন এত গভীর প্রেম, এত বিশাল ভাবে ভাবতে কোনো কবিই হয়তো পারেননি। তাই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি প্রেমিক কবি। প্রকৃতি নিছকই ঠুনকো বিষয় নয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রকৃতির সন্তান কবি তাঁর জীবন ও বিচিত্র সাধনায় একে পৃথক স্থান দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রতি গভীর আকর্ষণের সাথে সাথে তিনি আজ ও বিশ্বকবি। তাঁর সফল কর্মের মাধ্যমে তিনি আমাদের চেতনার অনুভবে বিশ্ববাসীর হৃদয় জুড়ে তিনি ছিলেন আর থাকবেনও। বিশ্বকবির অবদান এক বিশাল সাগরের ন্যায়। সেই সাগরের থেকে ক্ষুদ্র কণাবিন্দু আমি আমার আলোচনার মানসে ওঁনার সম্বন্ধে ফুটিয়ে তুললাম।