Logo
logo

সাহিত্য / কবিতা

নববর্ষে নবহর্ষে

"হে চিরনূতন, আজি এ দিনের প্রথম গানে।
জীবন আমার উঠুক বিকাশি তোমার পানে।।"

প্রকৃতির নিয়মে পুরাতন স্মৃতি ভুলে নূতনকে বরণ করে নেওয়া আমাদের চিরাচরিত ধর্ম।

চৈত্রের শেষ বেলায় নিদারুণ দাবদাহে প্রকৃতি মা যখন হয়ে যায় ক্লান্ত, শ্রান্ত , তখন দগ্ধ শুষ্ক চরাচরকে সিক্ত করতে নবরূপে নবসাজে আবির্ভাব ঘটে বৈশাখ মাসের। বর্ষ শেষের ক্লান্তি মুছে দিতে সুজলা সুফলা বৈশাখের আগমণী বার্তা জানিয়ে দেয় শীতল হাওয়ার আঁচল বিছিয়ে রুদ্রবীণাকে শান্ত করার নবমন্ত্র।

নতুন বছরের সূচনা হয় এই বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে। তাই বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে প্রথম দিনটিকে নানা ভাবে উদযাপন করা হয়। প্রত্যেক বাড়িতে আলপনা দিয়ে দ্বার-ঘট সাজিয়ে লক্ষ্মী গণেশের পূজা করা হয়, গৃহে সুখ সমৃদ্ধির জন্য। সংসারের মঙ্গল কামনায় এই পূজা করা হয়।
সকালে পাড়ায় পাড়ায় প্রভাতফেরি হয়, নাচ গান আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। সারাদিন চলে এই ধরনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

এই বৈশাখের প্রথম দিনটিকে স্বাগত জানাতে অনেক পাড়ায় বৃক্ষরোপণ করা হয়। প্রকৃতিকে সুজলা সুফলা করার প্রয়াস চলে গ্রামে-গঞ্জে ও শহর কলকাতায়। এই কংক্রিটের শহরকে কিছুটা শীতল করার চেষ্টা মাত্র। কোনো কোনো পাড়ায় শিশুদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।পার্কের দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর চিত্র অঙ্কন করা হয়, যাতে সারা বছর শিশুরা খুশিতে মেতে ওঠে। আবার কোনো কোনো পাড়ায় ফুটবল ম্যাচ হয় সকালের দিকে। এই রকম নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনটিকে উদযাপন করা হয়। তারপর চলে নানা মিলন উৎসব। সন্ধ্যা থেকে চলে সান্ধ্য বৈঠকী আড্ডা। বয়স্ক থেকে যুবক, সকল বয়সের ছেলে মেয়ে তাতে অংশগ্রহণ করে। নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি সবকিছুই থাকে এই আড্ডায়। আর থাকে খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা। বাঙালিয়ানাকে বজায় রেখে মাটির থালায় আর গ্লাসে চলে ভুঁড়িভোজের আয়োজন। বেশির ভাগ বাড়িতে থাকে বাঙালি খাওয়ার আয়োজন। নানা রকম সরবত থাকে খাদ্য তালিকায়। বয়স্কদের কথা মাথায় রেখে অনেক বাড়িতে মাটির কলসি ও হাত পাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই ভাবে চলে বৈশাখের দিনটিকে মনোরম করে তোলার প্রয়াস। অনেক আনন্দের মাঝেও থাকে চিন্তার কালো মেঘ। বৈশাখ মাসের বিকেলের দিকে ঝড় ওঠে। সঙ্গে চলে বৃষ্টি, বিদ্যুতের ঝলকানি আর বজ্রপাত। ভয় সবাই কুন্ঠিত হয়ে পড়ে। গ্রামে গঞ্জে ক্ষতি হয় এই কালবৈশাখী ঝড়ে। মাটির বাড়ি, বড় বড় গাছ ভেঙে যায়। বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটে অনেক মানুষের। তাই সুখ দুঃখের মাপকাঠিতে এই ঋতুকে মাপা যায় না।

প্রকৃতি ও সেজে ওঠে শুভ্র বসনে। জুঁই, বেল, রজনীগন্ধা, কেতকী তাদের মিষ্টি গন্ধে সুবাসিত করে তোলে চারপাশ।
আম্রকাননে মুকুলের সম্ভার।

এছাড়া ব্যবসায়ীরা এই দিনটিকে হালখাতা উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করেন। প্রত্যেক দোকান সেজে ওঠে আলোক সজ্জায়। ফুল, মালা আর অতিথি আপ্যায়নের মধ্যে দিয়ে চলে গনেশ পূজার অনুষ্ঠান। অতিথিদের দেওয়া হয় ঠান্ডা পানীয় ও মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার।

পয়লা বৈশাখে বাঙালিদের মধ্যে নতুন জামাকাপড় পরার নিয়ম আছে। বেশির ভাগ মানুষই সুতির ঢিলেঢালা পোশাকে সেজেগুজে বেড়াতে যায়। এই দিন সবাই ভালো ভালো খাবার খায়, তাই রেস্টুরেন্টর বাইরে থাকে লম্বা লাইন। বিকাল থেকেই বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের হাত ধরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে দোকানে যায়।

এই বৈশাখ মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অনেক দম্পতি। তাই বৈশাখ মাসে পঞ্জিকার প্রকাশ ঘটে। ক্যালেন্ডার যেমন প্রতি বাড়িতে প্রয়োজন হয়, তার মাধ্যমে আমরা বারো মাসের ছুটি, পূজার্চনা সম্বন্ধে জানতে পারি, সেই রকম পঞ্জিকার গুরুত্ব ও অপরিসীম। এভাবেই পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে জড়িয়ে থাকে বাঙালির হৃদয় ও মননে, বৈশাখের ঐতিহ্য ও গুরুত্ব।
তাই তো কবি কন্ঠে উচ্চারিত হয়,
"জীবন যখন শুকায়ে যায়
করুণা ধারায় এসো,
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
গীত সুধারসে এসো।।"

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com