Logo
logo

গল্প / কাহিনী

বিসর্জন

মালদা শহরে মহানন্দা নদীর খুব কাছেই সুচরিতার বাড়ি। এই মহানন্দা নদীটিকে সুচরিতা বাড়ির ছাদ থেকে বেশ উপভোগ করতো।বর্ষার সময় নদীতে পাল তুলে মাঝিরা নৌকা বাইতো। বর্ষাকালে নদীর জল বেড়ে যায় আবার গ্রীষ্মকালে জল প্রায় শুকিয়ে যায়। সুচরিতার পাড়াতেই ভাড়া থাকতেন রঘু কাকু আর লক্ষ্মী কাকিমা। খুবই শান্ত প্রকৃতির। রঘু কাকুরা চার ভাই। একটি সাইকেলের দোকান ছিল, সেই দোকানের উপর নির্ভর করে চলতো চার ভাইয়ের সংসার।ঝগড়া অশান্তি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।একদিন রঘুকাকুকে দোকানটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করে তাঁর ভাইয়েরা।বড়ো ছেলে সুবীর মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে, সংসারে অভাবের পরিস্থিতিতে আর পড়াশোনা করা হয় নি। কাজেই এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে এবং কাকু, কাকিমা আর চার ভাইবোনকে নিয়ে ওঠে সুচরিতার পাড়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে। বাড়ির মালিক ছিলেন অত্যন্ত নম্র স্বভাবের। সন্দীপ, সুকেশ, প্রীতি আর পিউ পড়াশোনা করে। সুচরিতা দেখতো সকালে রঘু কাকু নদীতে স্নান করতে যেতো।পাড়াতে থাকতো বলেই প্রীতির সাথে যোগাযোগ ছিল আর দুজনেই একই শ্রেণীতে পড়তো ফলে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এর পরে সুচরিতা মালদার বাইরে পড়তে যায়, এদিকে পিউ আর ওর দিদি প্রতিমারও বিয়ে হয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ করে সুচরিতা মালদায় ফিরে আসে এবং যথা সময়ে বিয়ে হয়ে যায়। সুচরিতার স্বামী শহরের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী।বিয়ের পরে বাবার বাড়িতে গেলে পাড়ার সবার সাথে আর আগের মতো দেখা সাক্ষাৎ হতো না, তবে অন্যত্র ভাড়া চলে গেছে রঘু কাকুরা। সুচরিতা ওর স্বামীর চেম্বারের সব কর্মীদেরকেই চিনতো কিন্তু সন্দীপকে পরিচিত বলে মনে হলেও সঠিক মনে করতে পারেনি,সন্দীপ ছিল ওর
স্বামীর ইন্টার্নি। এরপর কেটে গেছে প্রায় পনেরোটা বছর। একদিন সুচরিতার স্বামী বলল "সন্দীপ আমাদের পাড়াতে এসেছে এইতো পাশের গলিতে, ওর মায়ের সাথে আলাপ করে খুব ভালো লাগলো,আজকে সন্ধ্যেবেলা যাবো।" সন্ধ্যেবেলায় সেদিন আর যাওয়া হয়নি, কারণ সুচরিতার স্বামী নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। প্রায় সপ্তাহ খানেক বাদে সন্দীপের ভাড়া বাড়িতে যায়। কলিং বেলটা বাজতেই দরজার খোলেন একজন বয়স্ক মহিলা একটু অন্ধকার থাকায় মুখটা ভালো করে দেখতে পায় নি সুচরিতা,ঘরে ঢুকতেই আলোতে উনার মুখটা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়... "কাকিমা তুমি এখানে? " "সুচরিতার স্বামী বলে ওঠেন " তুমি চেনো নাকি?"
সুচরিতা বলে "হ্যাঁ কাকিমা আমাদের পাড়াতে আগে থাকতেন?"
তারপর সব কথা শোনে,সুবীর নিজেই এখন ঠিকাদারী করে,বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। রঘু কাকু একটা জায়গা কিনেছে বাড়ি করবে বলে কিন্তু বাড়ি করা হয়ে ওঠে নি। সুচরিতার স্বামী ব্যস্ত মানুষ, কথা বলার সময় খুবই কম,ছেলেপুলে নেই বড্ড একাকী লাগতো কাজেই সময় পেলেই চলে আসতো বহু পরিচিত লক্ষ্মী কাকিমার কাছে। সন্ধ্যে পর্যন্ত নানান গল্প করে আবার বাড়ি ফিরে যেতো।
সুচরিতা যেন নতুন একটা জীবন খুঁজে পেয়েছিল।এদিকে আবার বৃদ্ধা শাশুড়িমা আছেন তাঁকেও দেখাশোনা করতে হতো। বেশ কয়েক দিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি, একদিন বিকেলেবেলা গিয়ে হাজির হলো সুচরিতা, দেখে কাকিমা শুয়ে আছে।
ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলো "এই অসময়ে শুয়ে? "
কিছুক্ষন কথা বলার পর সুচরিতার হঠাৎ চোখে পরে কাকিমার চেহারাটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে।
জিজ্ঞাসা করে -"কাকিমা তোমার চেহারাটা এত শুকনো লাগছে কেন, শরীর ঠিক আছে তো? "
লক্ষ্মী কাকিমা উঠে বসে বিছানার উপরে।
বলেন " ওরে বয়সটা তো হচ্ছে রে।"
সন্দীপ কোর্টের যায় তাই তাড়াতাড়ি রান্না করা,সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম নিজেই একা সামলান।
ইদানিং সুচরিতা লক্ষ্য করতে থাকে যে লক্ষ্মী কাকিমা একটুতেই হাফিয়ে উঠছে,বেশ ক্লান্তি বোধ করে, কথা বলতেও বেশ কষ্ট হয়।হঠাৎ একদিন দেখে চেহারাটা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ঠোঁটের কোণ দুটো ফেটে গেছে, গায়ে হাল্কা জ্বর আছে।সুচরিতা
ঘরের বাইরে গিয়ে একটি ফোন করে বলে
"বাপি কালকে একটু আসিস তো রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।"এই বাপি প্রায়ই বাড়িতে এসে সুচরিতার মায়ের নয়তো শাশুড়িমায়ের দুই বাড়িতেই রক্ত নিয়ে যায় পরীক্ষা করার জন্য দুজনেই তো বয়স্ক মানুষ। মনে হয় সুচরিতা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল।
যাইহোক ছোট ছেলে সুকেশ ঢুকলো বাড়িতে
সুচরিতা বলে "কাকিমার জ্বর চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে একটু দেখবি তো।"
সুকেশ অমনি বলে ওঠে "সারাদিন জল ঘটবে জ্বর হবে না তো কী হবে।"একটা প্যারাসিটামল দিল। সুচরিতা বেরোতেই সন্দীপ বাড়ি ঢুকলো, সুচরিতা বলে কাকিমার শরীরটা ভালো নেই, আগামী কালকে একটি ছেলে রক্ত নিতে আসবে আমি তোমাদের না জানিয়েই আসতে বলেছি। সন্দীপ বোধহয় ব্যাপারটা তখন ভালোভাব বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু এইটুকুই বললো "বৌদি মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে আপনি বলে দিয়েছেন খুব ভালো করেছেন'"।
পরের দিন বাপি রক্ত নিয়ে যায় একদিন বাদে রিপোর্ট আসে।হিমোগ্লোবিন একেবারেই কম মাত্র ৬। সেদিন রাতের বেলা লক্ষ্মী কাকিমাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয় তিন বোতল রক্ত দেওয়ার পরে অর্থাৎ দুইদিন নার্সিং হোমে থাকার পরে বাড়ি ফিরে আসে। চলল নানান রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা ধরা পরে গলব্লাডার স্টোন হয়েছে। একমাসের মধ্য অপারেশন করা হয়। অদ্ভুত কান্ড পাথর তো নেই। সুচরিতার স্বামী সন্দীপ আর ওর দাদাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখানোর উপদেশ দেয়। ওরা একদিন পরে কলকাতায় এসে ডাক্তার দেখায়, তিনিও অনেক রকমের পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন। যথা সময়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পূর্ণ হলো। রিপোর্ট দেখে সবাই বিমর্ষ হয় গেলো সুচরিতার তো মনে হয়েছিল যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো সেতো মরনাত্মক ব্যাধি কোলন ক্যান্সার।লক্ষ্মীকাকিমার যখন দুই বছর বয়স তখন ওনার বাবা মারা যান। কাকিমাই ছিলেন সবার ছোট। মেয়েবেলাটা খুব কষ্টেই কেটেছে। ওনার বড়ো দাদা ছিলেন উনি কাকিমার বিয়ে দেন।সেই বিয়ের দিন নাকি ধর্মঘট ছিল।মালদা জেলা তো বেশ বড়ো। তখন পুরােনো মালদা আর মালদা এই নামটাই ছিল। লক্ষ্মীকাকিমার পৈতৃক বাড়ি ছিল পুরােনো মালদায়। তখন মহানন্দা নদীর ব্রিজের কাজ চলছে। ধর্মঘট মানে সব বন্ধ। পায়ে হেঁটেই চললেন রঘুকাকু বিয়ের করতে। বরযাত্রীদের মধ্যে একজন নৌকা বাইতে পারতেন। তিনি সবাইকে নিয়ে নৌকায় করে বাকি পথ পেরিয়ে বিয়ে বাড়ি পৌঁছায়। কাকিমার বয়স তখন মাত্র ষোলো। তাঁদের মধ্যে বয়সের তফাৎ ছিল অনেকটাই।
সুচরিতার খুব মন খারাপ।চিকিৎসা শুরু হলো। কিন্তু এতটাই মানসিক শক্তি ছিল কাকিমার দেখে বোঝা যেত না উনি এতটাই অসুস্থ। একদিন কী মনে হলো হঠাৎই লক্ষ্মী কাকিমার আর রঘু কাকু সুচরিতার শ্বশুরবাড়িতে আসেন বিকেল বেলা। সেদিন ছিল রবিবার। সন্দীপ তো প্রায় রোজই আসে সুচরিতার স্বামীর কাছে। সিনিয়র অ্যাডভোকেটের কাছে অনেক কিছুই জানার থাকে। সুচরিতা অবাক হয়ে গেছিলো লক্ষ্মী কাকিমা এসেছে। ঢুকে বলল "দেখতে এলাম তুই কেমন সংসার করছিস।কয়েক দিন ধরেই ভাবছি আসবো।"বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর হাঁফাতে থাকেন।সোফার উপর একটু মাথাটা রাখেন। সুচরিতা বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। রঘু কাকু জানতেন না তাঁর স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত। কিছক্ষন বিশ্রাম নেওয়ার পর সুচরিতার স্বামী বাড়ি পর্যন্ত ওনাদের এগিয়ে দেন। পরের দিন সুচরিতা যায়।রঘু কাকু বলেন "তোর কাকিমার কী যে হয়েছে বুঝতে পারছিনা রে খেতে তো পারছে না, আবার এতগুলো ওষুধ খেতে হবে"। সুচরিতা তো জানে সব। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ঘরে ঢুকে দেখে কাকিমা খাটের উপর হেলান দিয়ে টিভি দেখছিলেন।
"এসেছিস বস, একটা ভালো মেয়ে দেখতো সন্দীপের জন্য, আমি বিয়ে না দিলে ওর বিয়েটা নিয়ে কেউ ভাববে না।"
সুচরিতা বলে ঠিক আছে আগে তুমি সুস্থ হও। পরেরদিন কেমোথেরাপি হবে কাজেই সুচরিতাকে যেতে হবে সাথে। তিনি নিজেও জানেন না যে তিনি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। কেমোথেরাপির পর খুব কষ্ট অনুভব করতেন। সুচরিতার হাতের রান্না খেতে খুব ভালোবাসতেন, প্রায়ই সুচরিতা কিছু ভালো রান্না করে পাঠাতো। একদিন তিনি বলেন "জানিস আমার বোধহয় আর নিজের বাড়ি দেখা হবে না।""চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো।সুচরিতাও কেন যেন কোনো কথা বলতে পারলো না।
একদিন
সুচরিতা মেটে চচ্চড়ি নিয়ে হাজির দুপুরে, খুব খুশি হয়েছিলেন কিন্তু খেতে পারেন নি একটু মুখে দেওয়া শুধু।ছয়টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। দিন যায় শরীর ক্ষীণ হত লাগলো। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে, খুব আস্তে আস্তে কথা বলে।সুচরিতা এখন বেশিক্ষণ সময় থাকে কাকিমার পাশে। এইভাবেই ছয় মাস কেটে গেলো। লক্ষ্মী কাকিমা একেবারে বিছানা শয্যাশায়ী।আশ্বিন মাস এলো,শরতের ঝলমলে রোদ্দুর, কাশ বন দুলছে হাওয়ায় শিউলি ফুলের গন্ধ ভরা রাত, চারিদিকে পুজোর আমেজ।
এখন কিছুই খেতে পারে না শুধু তরল জাতীয় খাবার খায় তাও আবার মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরে যায়। পুজো চারিদিকে হচ্ছে সুচরিতা কে কী যেন বলতে চেয়ে ছিল কিন্তু বলতে পারলো না। শরীরে কিছু নেই ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে চোখের পাতা দুটো আধ বোজা অবস্থায়।সুচরিতা চুপচাপ পাশে গিয়ে বসে থাকে, রঘু কাকু একটা চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে আস্তে আস্তে তিনিও বুঝতে পেরেছেন সব। একটু মেঘলা আকাশ আজকে চারিদিকে দশমীর বিসর্জনের ঢাক বাজছে, লক্ষ্মী কাকিমার নিঃশ্বাসটাও ছোট হতে লাগলো।হঠাৎ যেন সুচরিতার কাছে হাতটি এগিয়ে দেয়, ঢাকের শব্দের সাথে লক্ষ্মী কাকিমা বিলীন হয়ে গেলো। চোখ দুটো স্থির হয়ে রয়েছে। রঘু কাকু শুধু একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ছলছল চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আকাশে দিকে তাকিয়ে থাকলো করুন দৃষ্টিতে। লক্ষ্মী কাকিমার শেষ ইচ্ছে ছিল নিজের একটা বাড়ি হোক,সেই ইচ্ছেটা অসম্পূর্ণই থেকে গেলো। আজও সুচরিতা রঘুকাকু আর লক্ষ্মীকাকিমার কেনা ফাঁকা জায়গাটা দেখে শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে। কেউ কি বুঝতে পেরেছিল যে লক্ষ্মী কাকিমা এইভাবে সবার চোখের আড়ালে চলে যাবে। বৃদ্ধ রঘু কাকু এখন একেবারেই একা। বাড়ি থেকে একটু দূরে বহু পুরোনো একটি বটগাছের তলায় সারাদিন বসে থাকেন, সন্ধ্যের পরে সন্দীপ আসলে ঘরে ফেরেন। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা মাঝে মধ্যে এসে দেখা করে যায়। সম্পর্ক শুধু রক্তেরই হয় না, হয় মনের, হয় ভালোবাসার, হয় স্নেহের।স্নেহ, ভালোবাসা এই গুলো দিয়েই তৈরি হয় সম্পর্ক।হিংসা, ঘৃণা, ঈর্ষা, উঁচু, নিচু জাতি বর্ণ বিভেদে নয়। আর অতীতই স্মৃতি হয়ে যায়। এই স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকা। এখনও দূর্গা পূজার দশমীর বিসর্জনের ঢাকের সাথে লক্ষ্মী কাকিমার মুখখানা ভেসে ওঠে সুচরিতার মনে।।

<<Prev1234Next>>

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com