নতুন জীবনের আঙিনায়
মধুর বন্ধন ক্রমাগত ছুটে চলা আমাদের জীবনে খানিক বিরতি আনে উৎসব। তা সে পূজো পার্বনের উৎসব হোক বা নিজেদের আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠা কোন ঘরোয়া উৎসবই হোক। কদিন আগে এই রকম এক বিবাহ উৎসবে মেতে উঠেছিলাম। সারা বছরে হয়তো একবারও দেখা হয় কি না হয় এমন মানুষদের কয়েকটা দিন কেটে যায় একসাথে একপাতে। কুশল বিনিময়ের সাথে সাথে চলতে গিয়ে অজান্তেই কখনো প্রবেশ করি এক অপরের অজানা পরিসরে গল্পের মধ্যে দিয়ে। আবার হয়তো হঠাৎ করেই আলাপ হয়ে যায় একবারে নতুন আনকোরা কোনো মুখের সাথে। এই বিয়েবাড়ির আলাপ আন্তরিকতা বাড়তে বাড়তে কখনো ভালবাসার রং ধরে নেয় এমন উদাহরণ অনেক আছে। তখন ফাগুন মাস। গ্রামের মেঠো রাস্তার পাশে লাল টুকটুকে শিমুল পলাশের সমারোহ। কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে চলছে সাজানো গরুর গাড়ি। সঙ্গে নতুন বর কনে। রাস্তার দুধারে সবুজ ধানের ঢেউ খেলানো চাষের জমি, জল টলমল পুকুরে পদ্ম পাতায় বোস আছে এক রঙিন পাখি। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ দেখে বিচ্ছেদের কষ্ট নিয়ে বিষন্ন মুখের নতুন কনের মনের দুঃখ কিছুটা হালকা হতে চলেছে। এই সব অনেক আগের কথা। সময়ের সাথে সাথে এই ছবি পাল্টে গিয়েছে। তখনকার বিয়ের সঙ্গে এখনকার বিয়ের আকাশ পাতাল তফাৎ। এখনকার বিয়েবাড়ি মানেই ভাড়াবাড়ি। আর তাকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য থাকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজন। আগে প্রায় সব বিয়েবাড়িতে রাতে বসত ভিয়েন। তাতে তদারকি করত কোনো রাসভারী পিসে, জেঠু, বা মামা। তাদের দায়িত্ব ছিল দেখার মতো। একটা বিয়েবাড়িতে কিছু নিয়ম স্ত্রী আচার যেমন থাকে তেমনি থাকে প্রত্যাশার চাপ। কিন্তু কালের নিয়মে উঠে আসা নতুন মুখগুলির ভূমিকা অপরিহার্য। বড়রাই তাদের হাতে ধরে শেখায় বিয়ের নিয়ম কানুন। তা না হলে ঐতিহ্যের পরম্পরা যে ধরে রাখা যায় না। অবশেষে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আত্মীয় বন্ধুরা যে যার ঘরে ফিরে যায়। এদিক ওদিক পরে থাকে উপহারের রঙিন মোড়ক গুলি। রাত জাগার ক্লান্তি চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে কাটে ঘরের মানুষগুলোর দিন। এক জায়গায় নতুন করে অভিযোজিত হতে হয় নব বধূকে। নতুন বাবা , মা ও তার মনের মানুষটিও যথা সম্ভব চেষ্টা করে তাকে আপন করে নেওয়ার। কিন্তু অভিযোজনের এই সময়ে মন খারাপের রেশ রয়েই যায় তার মনে। সন্ধ্যার অবসরে মনে পরে যায় মায়ের সঙ্গে গল্প করার মুহূর্তগুলো, ছুটির দিনে দুপুরে স্নান করতে দেরি হলে মায়ের মিষ্টি বকুনি, অথবা খাবার টেবিলে বাবা বা ভাই বোনের সঙ্গে তুমুল তর্ক আড্ডার সেই ক্ষণ গুলো। তারপর দিন চলে যায় তারিখ সময় পাল্টে যায়। ধীরে ধীরে পিছনের ফেলে আসা স্মৃতি ধূসর হতে থাকে। আর সেদিনের নববধূটিও নতুন জীবনের নতুন অভ্যাসে নিজেকে মানিয়ে নেয়। একদিন সময় আসে এই বাড়ি সংসার তার একান্ত আপন হয়ে যায়। মহাভারতের আদি পর্বে ঋষি উদ্যালকের পুত্র সেতুকেতু সর্বপ্রথম বিবাহ প্রথার প্রচলন করেছিলেন। যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্যে তা শ্রেষ্ঠ। সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিয়ম আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এখনো প্রেম ভালবাসা পরিণতি পায় শুভ পরিণয়ে। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে। স্বাধীন চেতা মনোভাবের কিছু মানুষ বিবাহের বন্ধন ছেড়ে , " লিভ ইন" করার পক্ষপাতী । তবুও সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের আস্থা থেকেই গেছে বিবাহ নামের এই সুন্দর মাঙ্গলিক ব্যবস্থায়। সুস্থ সমাজের জন্য এটাও কম আশার কথা নয়। তাই নয় কি?