আমার চেতনায় ও অনুভবে বিশ্ব কবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিভূ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নামটির সাথে যুক্ত হয়ে আছে আপামর বাঙালীর গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, এবং আবেগ। তিনি ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের মননে, চিন্তাধারায় অমর হয়ে আছেন,থাকবেনও চিরকাল।লাল রঙের বিশাল বাড়ি। আর এই বাড়ির মাঝখানের অংশে রয়েছে বিশাল সবুজ রঙের চত্বর। লাল আর সবুজের সংমিশ্রণে ৬নং দ্বারকা নাথ লেনের বাড়িটিতে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস, বহু সাহিত্য, এবং বহু স্মৃতি। সাহিত্যের নবজাগরণ ঘটেছিলো এই বাড়ির অন্দর মহল থেকেই। বাংলার ১২৬৮সালের ২৫শে বৈশাখ, ইংরেজির ১৯৬১সালের ৯ই মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের এবং মাতা সারদা সুন্দরী দেবীর ১৪তম সন্তান। শৈশবেই মাতৃ হারা হন কবি। পিতাকে কার্যসূত্রে বাইরে যেতে হতো। কাজেই ছোট্ট রবির শৈশব কেটেছে বাড়ির ভৃত্যদের অনুশাসনে। ছেলেবেলায় তাঁর পড়াশোনায় মন থাকতো না। তিনি একা একা একটি গন্ডিচক্রের মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। চিলের কোঠার ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন বাইরের দিকে। উপভোগ করতেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কে। ছেলেবেলায় তিনি অত্যন্ত আবেগী ও দরিদ্রের সমব্যথি ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই তিনি প্রথম লেখা শুরু করেন। তত্ত্ববোধনী পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা "অভিলাষ" প্রথম প্রকাশিত হয়। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতি প্রেমী। স্কুলের বদ্ধ গন্ডির মধ্যে তাঁর পড়াশোনা করতে ভালো লাগতো না। তবুও তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট, বেঙ্গল একাডেমির মতো কিছু নামী বিদ্যালয়ে কিছুদিনের জন্য পড়াশোনা করেন। গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন। শৈশব থেকেই তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু ছোট ছোট কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সিঁড়ি আর ছাদ ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। এই ছাদে বসেই তিনি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান ও উপন্যাস। করেছেন নাটকের মহড়াও। তাঁর একের পর এক সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে।১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাথ বধ কাব্যের সমালোচনা, ভানুসিংহের পদাবলী, ভিখারিণী, করুণা ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়।১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবি কাহিনী প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি সন্ধ্যাসঙ্গীত রচনা করেন, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ এই কাব্য গ্রন্থেরই অন্তর্গত।১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কবি ব্যরিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান। আইন নিয়ে পড়াশোনাও করেন। কিন্তু সাহিত্য চৰ্চার প্রতি আকর্ষণের কারণে তিনি আবার ফিরে আসেন ভারতে। গতানুগতিক শিক্ষা লাভ না করলেও বিশ্ব বিদ্যার সকল দরজা তাঁর কাছে
উন্মুক্ত ছিল। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভবতারিণীদেবীকে বিবাহ করেন। পরবর্তী কালে তাঁর নামকরণ হয় মৃণালিনীদেবী। এর বেশ কয়েক বছর পর পিতৃ আদেশ মান্য করার জন্য শিলাইদহ, পাবনা ও রাজশাহীতে তাঁর বিশাল পৈতৃক সম্পত্তি পরিচালনা করতে লাগলেন। সেইসময় বাউল লালন শাহের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। লালন শাহের গান গুলো তাঁকে প্রভাবিত করেছিল।১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কবির পত্নী বিয়োগ,১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পিতৃ বিয়োগ ঘটে।১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন।১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাখিবন্ধন উৎসব পালন করেন হিন্দু মুসলিম সকলকে নিয়ে।১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে নাইট উপাধি বর্জন করেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বুঝেছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা না করা গেলে মাটি ও মানুষের যে চিরন্তন সম্পর্ক সেটা আর টিকবে না।
প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাবনায় তিনি ছিলেন একজন অগ্রগামী চিন্তার মানুষ। রবীন্দ্রনাথের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাই তাকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করে; তাঁর জীবন দর্শন, মূল্যবোধ ও মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আর কোনো বাঙালির জীবনে ঘটবে বলে মনে হয় না। উনিশ শতকে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার যখন এক কথায় অকল্পনীয়, তখন কবি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী হিসেবে, যা আজও একই রকম ভাবে প্রাসঙ্গিক।y বর্তমানে যে বিষয়টি পরিবেশবিদ তথা সমগ্র মানবজাতির অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনচিন্তার প্রতিফলনও রেখে গিয়েছেন কাব্যে, গানে, সাহিত্যে, যার প্রাসঙ্গিকতা কখনওই অস্বীকার করা যায় না।
সুতরাং এ কথা সহজেই স্বীকার করা যায় যে রবীন্দ্রনাথের তুলনা রবীন্দ্রনাথ নিজেই।জীবনে অনেক মানসিক কষ্ট সহ্য করেছেন কবি। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি থেমে থাকে নি।সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যে তাঁর শৈল্পিকতা স্পর্শ করে নি। সেইসময় অবিভক্ত বাংলায় নবজাগরণের মধ্যাহ্নে রবি কিরণের উন্মেষ ঘটেছিল। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সত্য ও সুন্দরের ফল্গু ধারার মতো বহমান এবং সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে। বাংলা সাহিত্যজগতে হিমাদ্রির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক অলৌকিক ঐশ্বর্য নিয়ে। বাঙালির সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতির বহুলাংশ জুড়েই আছেন ধীমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালি তাই তাঁর প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি সংশয়ে আশ্রয় নেয় সেই রবীন্দ্রনাথের কাছেই। রবীন্দ্রনাথ নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার পরিধি দিয়ে বিস্তৃত করেছেন গোটা বাংলা সাহিত্যের পরিসর। আমরা তাঁকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় অভিষিক্ত করেছি। রবীন্দ্রনাথের সাফল্যের এই ক্রম-উত্তরণ কিন্তু একদিনে ঘটেনি। এক লহমায় তিনি ‘বিশ্বকবি’ বা ‘কবিগুরু’ অভিধায় ভূষিত হননি। সমগ্র সৃষ্টির পিছনে রয়েছে তাঁর
দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন বর্তমানের দৃষ্টির সীমানায়। যে দৃষ্টি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। জীবনের প্রভাত থেকে অন্তিমলগ্ন তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে বদলে দিয়েছেন বাঙালির মানসজগত এবং বাংলাকে দিয়েছেন বিশ্ব পরিচিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান। একে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, জীবন- চেতনায় রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই অপরিহার্য। আমাদের জীবনের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, মননের সঙ্গে, আন্দোলনে, ভাষার মাধুর্য্য, দেশপ্রেমে সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আমাদের প্রাণের টানে, জীবনের টানে, চেতনার টানে, শিল্প ও সাহিত্যের টানে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে। তাঁর কবিতার ছন্দ, বাণী ও সুর আমাদের হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় শান্তির শুভ্র পরশ। বাহিরের জগৎ এবং অধরা মাধুরী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন একের পর এক নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী প্রতিবছর সযত্নে পালিত হয়। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে স্কুলে কবিতা, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, রঙিন চিত্রকলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন সংগঠন এবং সোসাইটির সদস্যরা রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন
রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়, রবীন্দ্ররচনাপাঠ, আলোচনাসভার আয়োজন ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অন্যান্য দেশে যেখানে বাঙালী বসবাস করেন তাঁরাও রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপিত করেন ।রবীন্দ্র জয়ন্তী সর্বত্র দুর্দান্ত আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয় এবং অনেক জায়গায় প্রভাতফেরি হয়।রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি দারুন ভাবে আজকের সমাজে প্রাসঙ্গিক । কারণ রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি আমাদের এই অস্থিরময় জীবনে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারে, পারে আত্মগ্লানির হাত থেকে মুক্তি দিতে। দম বন্ধকর আবহাওয়া থেকে একটু খোলা হাওয়া এনে দিতে পারে রবীন্দ্রসংগীত । আমি তাঁকে মানবতার কবি হিসেবে উল্লেখ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তিনি সর্বকাল, সর্বদেশ ও সর্বমানবগোষ্ঠীর কবি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছেন।বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের শেষ প্রায় এক বছর কেটে ছিল রোগ শয্যায়। ৭ই অগাস্ট ১৯৪১, বাংলায় ২২শে শ্রাবন দুপুর বারোটার সময় অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে গেছেন অসংখ্য নাটক,কবিতা,উপন্যাস,
শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নিচে পড়া, আদিবাসী ও সাধারণ জনগণের রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করে গিয়ে ছিলেন।কিন্তু তিনি রয়েছেন বিশ্ববাসীর হৃদয় জুড়ে।কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। "হে নূতন,দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ। "