রবির আলোকে প্রকৃতি
" গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ,
আমার মন ভুলায় রে,,,,,,,"
ইট, কাঠ,পাথরের__এই শহরে বসে,এই গানের ঘ্রাণ,,দৃশ্যপটের বদল ঘটায় বৈকি। পিয়াসী মন বাউলের একতারার টুং টাং সুরের সাথে সাথে,দূরে কোন অদেখা সবুজ বনানী ঘেরা, রাঙা মাটির পথে পথে ঘুরে যে বেড়ায়।
রবীন্দ্রনাথ ও প্রকৃতি একে অন্যের ছায়া ও কায়া।রবির কিরণ যেমন প্রকৃতির প্রাণ স্বরূপ তেমনি রবি কবি ও প্রকৃতি একে অন্যের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে।সেই শৈশব থেকেই ছোট রবির ,প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ টান,,,যা আমরা তাঁর লিখিত "ছেলেবেলার কথা"__আত্মজীবনী তে পাই। দোতলার বারান্দায় ছোট্ট রবি ,পুকুরের জলে নারকেল গাছের পাতার প্রতিচ্ছবিতে যে হিল্লোল দেখেছিল ,, তারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন,, তাঁর রচিত বিভিন্ন গানে, গল্পে ও কবিতায়,,,," ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি, আছে আমাদের পাড়াখানি "। বাবার সাথে ট্রেন ভ্রমণে , জানালার বাইরের দৃশ্য দেখে তাঁর মনে হয়েছে,,,,গাছপালা, ঘর বাড়ি সবই তার সাথে ঝিক ঝিক করে ছুটে চলেছে,,, কল্পলোকে প্রকৃতির রূপ ধরা পড়েছে,," ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়,, ছোটো ছোটো গ্রাম গুলি"।।
শুধুই কি প্রকৃতির গাছপালা?নদ_নদী, পাহাড় ঝর্না সুনীল আকাশ,,,সবই তার "প্রকৃতি প্রেমের দুয়ারে" হানা দিয়েছে । নদীর গতি,,"আপন বেগে পাগল পারা"__কবিতার ছন্দে ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির সাথে তাঁর এক সখ্যতা গড়ে উঠেছে। প্রকৃতিকে পটভূমি হিসাবে নয়,__তাঁর ভাবনার উৎস তথা লেখনীর প্রাণ শক্তি হিসাবেই তাঁর সারা জীবনের সৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ও পরিবর্তনশীলতা।তিনি প্রাণ ভরে উপভোগ করেছেন। মুখের নিঃসৃত বাণীতে তার প্রকাশ ও করেছেন,,,"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে , মোরে আরো আরো দাও প্রাণ"।।
কবি গুরু বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতি আমাদের মনকে প্রভাবিত করে।প্রতিটি মানুষের মনে আধ্যাত্মিকতা, প্রেম ও মানবিক মূল্য বোধ ঘটায়। তাইতো 'বলাই ' গল্পে দেখি,,, বলাইয়ের পোঁতা গাছ কেটে ফেলায়,,,তার করুন পরিণতি। প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবনের এক আত্মিক সম্পর্ক যে বিদ্যমান,তা তাঁর অনুভূতিতে প্রকাশ ঘটিয়েছেন,ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের , বিভিন্ন লেখায়। তিনি অনুভব করতেন,প্রকৃতি থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই,, তা আমাদের নিজস্ব জ্ঞান, এতে কোনো কৃত্রিমতা থাকেনা। এই অনুভূতিকে সঙ্গী করেই তিনি প্রকৃতি ও শিক্ষার মধ্যে এক মেলবন্ধন স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এরই ফল স্বরূপ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন,প্রকৃতির মাঝে পাঠশালা, "শান্তিনিকেতন"।
উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে, এক আশ্রমিক পরিবেশে শিশুদের সহজ পাঠ শিক্ষাদান ও মনের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন,চার দেওয়ালের মধ্যে সময়ের টানা গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে নয়, খোলা আকাশের নীচে,সবুজ গাছের তলায় বসে পঠন পাঠন।ঘণ্টার ধ্বনিতে সমাপ্তি নয়, ডালে ডালে কুহুর কন্ঠে পড়ুয়াদের মন ছুটির ডানা মেলুক। নাচ,গান এর তালে তালে বসন্ত উৎসব রেঙে উঠুক। অশোক,পলাশ, শিমূলের রাঙা হাসিতে ভরে উঠুক আপামর গৃহবাসীর মন।জ্যোৎস্না রাতের চাঁদের আলোয় ভরা বনের সৌন্দর্য ,, গানের কলিতে চারিদিক মুখরিত ,,বর্ষার জলধারায় সিক্ত আনন্দিত ময়ূরের নাচে,,,প্রতিটি হৃদয় নেচে ওঠা,,,,, এ সবই তো তার প্রকৃতির প্রতি প্রেম,,ভালোবাসার নিদর্শন।
তিনি মনে করতেন প্রকৃতির মধ্যে থেকে যে শিক্ষা ও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় তা প্রতিটি মানুষের সৃজনশীলতা ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। তাই প্রকৃতিকে সুরক্ষা রাখা একান্তই আবশ্যক।
এ কথাটা অবশ্যই আমাদের মনে রাখা দরকার,,,তিনি যে সময় এই প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার কথা বলেছেন সেই সময় কিন্তু অধুনা পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন দানাই বাঁধেনি।
তাই প্রকৃতির প্রতি আমাদের আকৃষ্টতা,ভালবাসা,, ও এর সুরক্ষা,,,, এ সবই যে গুরুদেবের অবদান। এর জন্য আমার তাঁর কাছে চিরঋণী হয়েই ছিলাম,,,আছি,,, থাকবো ও।।
শুধু শ্যামল প্রকৃতিই নয়, রুক্ষ,বিধ্বস্ত প্রকৃতির মাঝেও রবির প্রভাব অপরিসীম। যখন প্রখর গ্রীষ্মে,,,"দারুন অগ্নিবানে, হৃদয় তৃষাই হানে"। আবার ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে,, সতৃষ্ণ নয়নে বর্হিবিশ্বে চোখ রাখা। "আউসের ক্ষেত জলে ভরো ভরো" কিংবা "আসে ভৈরব হরষে, নব যৌবন বরষা" বর্ষা কে যুবতীর ন্যায় অবলোকন,,, এ তো এক প্রকৃতির প্রতি প্রেমিকের যথার্থই ভালবাসা ও নিবিড় সম্পর্কের প্রকাশ। "ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু",,শরতের আভাস,,নতুন ধানের পরবে হেমন্তের আগমন অথবা "শীর্ণ বৃক্ষ শাখা যত ফুলপত্রহীন,,শীতের বৈরাগ্য রূপ। ঋতুরাজের আগমন বার্তা,,,"ফাগুন লেগেছে বনে বনে ",,,,, এ সবই প্রকৃতি পূজারী রবির মননে, কলমের আঁচড় এ ফুটে উঠেছে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৈনন্দিন জীবন ও সাহিত্য কর্ম প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রেম, একাত্মতা ও আত্মীয়তার প্রতিফলন দেখা যায়।প্রকৃতিবিষয়ক তাঁর এই ভাবনা, নিবিড় অনুভূতি বাংলা সাহিত্যে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে,,,,যা আজও অপরাজেয়। আমরা ,,প্রকৃতি প্রেমী মানুষেরা __প্রকৃতির মাঝে রবি কবিকে আবার রবির আলোয় প্রকৃতিকে অনুভব করি বৈকি।।
তাই আমার নিশ্বাসে,,বিশ্বাসে,,অনুভূতিতে,_"রবীন্দ্রনাথ ও প্রকৃতি"___একে অন্যের পরিপূরক।।