Logo
logo

গল্প / কাহিনী

ছোটগল্প - পৌষ পার্বণ

প্রাচীনকাল থেকেই পৌষ মাসের পৌষ পার্বণ নিয়ে মহাভারতে মকর সংক্রান্তির উল্লেখ আছে । পৌষ মাসের পৌষ পার্বণই পঞ্জিকাতে ' মকর সংক্রান্তি ' নামে পরিচিত।প্রাচীনকাল থেকেই পৌষ পার্বণে দেবতার পূজায় পিঠের অর্ঘ্য প্রদানের রীতি রয়েছে ।
গ্রাম বাংলার পৌষ মাস মানেই ' লক্ষ্মী মাস '। এই পৌষ মাসে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেতের সোনার ধান শীতের কোমল রোদে ঝলমল করে ।
পাকা ধান কাটার আগের দিন খামার বাড়ি ,বাড়ির উঠোন গোবর জল গুলে সেই গোবর গোলা জল দিয়ে ঝাঁটার দ্বারা লেপন দেওয়া হয় ।
গ্রামের জমিদার শ্রী পরান মুখার্জি গত হওয়ার পর স্ত্রী প্রিয়া দেবী শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছেন । প্রিয়া দেবী ফুলির মাকে বলে দিলেন ," আগামী কাল ভোর ভোর স্নান না সেরে আসিস , গোবর জলের লেপন দিতে হবে উঠোনে । ক্ষেতে কাল কাস্তে যাবে । লেপন দিয়ে সান বাঁধানো ঘাটে স্নান সেরে নিবি"। বিনুর মাকে কাজ দিলেন --- লক্ষ্মীর ঘর পরিষ্কার করে আলপনা আঁকা, কাঁসার কলসিতে জল ভরে আম পাতা রাখা , কাঁসার বাসন কোসন ঝকঝকে করে ধুয়ে রাখা।
টুসু গান গাইতে গাইতে দুই জন মহিলা মাঠ থেকে একগুচ্ছ ধানের শীষ কেটে নিয়ে এসে গোলা দেওয়া উঠোনে বসে ধানের শীষ নিয়ে বিনুনি করে আউনি বাউনি তৈরি করতে শুরু করল । ধানের শীষের বিনুনি তৈরি করে গিন্নিমায়ের হাতে দিয়ে গেল , গিন্নীমা দেওয়ালে পোঁতা একটা ছোট পেরেকে ঝুলিয়ে দিলেন , এটি ধান্য লক্ষ্মীর আদিমতম প্রতীক । গ্রাম বাংলায় এই প্রচলন আদিম কাল থেকে চলে আসছে । গ্রাম বাংলার প্রায়ই ঘরে ঘরে আজও ধানের শীষ বিনুনি ঝুলানো থাকে ।
যেই নতুন ধান খামারে এল । ধান ঝাড়াই শুরু হতেই সেই ধানের ঢিপ থেকে গিন্নিমার আদেশ --- দুই চার ডালা নতুন ধান এক বেলা রোদে শুকিয়ে ডালা ভরা ধান নিয়ে ঢেঁকিতে কুটে চাল থেকে আটা তৈরি করতে হবে ।
কাজের দুই মাসি , বিনুর মা আর ফুলির মা কাচা কাপড় পরে শঙ্খ তিন বার বাজিয়ে ঠাকুর ঘরে শঙ্খ রেখে ---
" এসো পৌষ যেও না জন্ম জন্ম ছেড়ো না ,
আঁধারে , পাঁদারে পৌষ ঘরের কোন বোস
পৌষ এলো গুড়ি গুড়ি , পৌষ মাসের মাথায় সোনার ঝুড়ি"।
--- এই গান গাইতে গাইতে ঢেঁকিতে পা রেখে ধান ভাঙতে শুরু করলো ।
প্রিয়া দেবীর চার ছেলে মেয়ে । এক ছেলে , এক মেয়ে প্রবাসে থাকেন । এই পৌষ মাসেই মাসের বড়দিনের ছুটি পড়ে তারাও গ্রামে মায়ের হাতের পিঠে পুলি খেতে আসেন । বাড়িতে বড়ো ছেলে শিবনাথ থাকেন।
তিনি ও শম্ভু গঙ্গা স্নান সেরে এসেছেন । তারও এক ছেলে এক মেয়ে । মেয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার ডিগ্রী করছে । ছেলে কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ।
বিদেশ থেকে ভাই বোন আসেন মায়ের হাতের পিঠে পুলি খেতে । মালদা থেকে সুধাও পাড়ি দিতে বিলম্ব করে না ।
শিবনাথ বাবু প্রত্যেক খেজুর গাছের গলায় একটা করে হাঁড়ি ঝোলানোর নির্দেশ দিয়েছেন খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য। ভাই বোন আসছে ওদেরওতো গ্রাম্য জীবনের স্বাদ গ্রহণ করাতে হবে । তাছাড়া ওই রস বড়ো পাল্টা খোলাই দিয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হবে , সেই বিশুদ্ধ গুড় দিয়ে পিঠে পুলি খাওয়া । পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ নারকেল গাছ সেই নারকেল গাছ থেকে পাঁচ ছ'টা নারকেল নামিয়ে এনে উঠানে রাখা হলো । শম্ভু শিবনাথ বাবুর গোয়াল সামলান । সে নারকেলের ছোবড়া ছাড়িয়ে বড়ো বৌমার হাতে দিল । তৎক্ষণাৎ বৌমা নারকেল কোরা দিয়ে নারকেল কুড়ে পুর বানিয়ে রাখলেন ।
সমস্ত ধান ঝাড়াই হয়ে যখন গোলায় উঠে গেল , গোলার মাথায় একটা লোহার বেড়ি দেওয়া হল , গায়ে গোবরের লেপন দিয়ে লক্ষ্মীর পদ চিহ্ন এঁকে দিলেন বৌমা । খামার বাড়িতে খড়ের পালা দেওয়া সম্পূর্ণ করা হয়ে গেল ।
বাড়ি ভর্তি লোকজন প্রবাসী ছেলে মেয়ে এসে গেছেন সঙ্গে তাদের ছেলে মেয়েরা , বাড়িতে কাজের মাসি বিনুর মা, ফুলির মা,শম্ভু তাছাড়া ক্ষেতে যারা কাজ করেন তাদের আসা যাওয়া -- বাড়ি একবারে গমগম করছে ।
ঠিক পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন রাত্রে গিন্নিমায়ের নির্দেশে গোবরের গোল গোল নাড়ু করে তার মধ্যে সিঁদুরের টিপ ও দুর্বা ঘাস গুঁজে সেই গোল মণ্ডলীকে তুলসী মঞ্চের সামনে গোয়াল ঘরে , ধানের গোলায়, ঠাকুর ঘরে, সদর দরজায় নতুন চালের গুঁড়ি গোল করে মারুলি দেওয়ার মতো ছড়িয়ে দিয়ে তার মাঝখানে গোবরের গোল মন্ডকে রেখে দেওয়া হলো। পরের দিন ভোর ভোর বড়ো বৌমা ঘাটে স্নান সেরে ফিরতেই নাপিত বউ পায়ে আলতা পরিয়ে দিল। লাল পেড়ে শাড়ি পরে গলায় কাপড় জড়িয়ে সেই গোবরের মন্ডতে মুলো ফুল ও সর্ষে ফুল দিয়ে শঙ্খধ্বনি এবং উলুধ্বনির সাহায্যে পুজো সেরে নিলেন । লক্ষ্মী দেবীর সামনে এক সের নতুন আতপ চাল চূড় করে ভরে চালের মাথায় একটা গাঁদা ফুল দিয়ে প্রণাম সেরে বড়ো বৌমা বেরোলেন।তৎক্ষণাৎ বিনুর মা ও ফুলির মা ও স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে উপস্থিত হয়ে গেছে । শম্ভুও স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে হাজির । প্রবাসী দাদাবাবু, দিদিমনি দিভাই তাদের ছেলে মেয়েরা এসেছে তাদের আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না হয় । রাত ভর জেগে খেজুর রসের গুড় বানিয়েছে বিশুকাকু। উনিই প্রত্যেক বছরই গুড় বানান সেই বাবার আমল থেকেই ।
তারপর বড়ো বৌমা কাজের দুই মাসি নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলেন । চালের আটার খামির তৈরি হয়ে গেল, গিন্নিমাও হাত লাগিয়েছেন , নিজে ক্ষীরসা, নারকেলের পুর বানিয়ে রাখলেন। বড়ো হাঁড়ির এক হাঁড়ি খেজুর গুড়ের নতুন চালের পায়েস চড়িয়ে দিলেন ।
ক্ষীরসা পুর ভরে পাটিসাপটা, ভাপা পিঠে, পুলি পিঠে, দুধ পুলি, দুধ চিতুই, নারকেলের পুর ভরে মুগ ডালের ভাজা পিঠে, নলেন গুড়ের ভাঁড় সন্দেশ, নলেন ভাঁড় ভাপা পিঠে, গাঁদা ফুল পিঠে ভাপা , সরুচাকলি পিঠে, দুধ সরু চাকলি, নারকেলের পুর ভরে পাটিসাপটা ইত্যাদি নানারকম পিঠে বানিয়ে গিন্নিমার সামনে দেওয়া হলো।
তাছাড়া বাড়িতে রান্না করছে শম্ভু ও দুই দাদা বাবু নতুন আতপ গোবিন্দ ভোগ চালের পোলাও আর মুরগির মাংসের কোরমা , ছোলার ডাল দিয়ে আলু সঙ্গে ডিম ভেজে ঐ ডালে ঢেলে দেওয়া ।
পৌষ পার্বণ , তাই সেদিন গিন্নিমা বাড়ির ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কাজের মাসি , ক্ষেত মজুর সকলকে নিজের হাতে খাবার বেড়ে দেন। গিন্নিমা নিজের ছেলে মেয়ের মতো আজ সকলকে আদর যত্ন করে বাড়ির তৈরি প্রত্যেক পদ বাড়িতে বসিয়ে খাওয়ান ।
খাওয়া দাওয়া সেরে গিন্নিমাকে প্রণাম করে, ক্ষেত মজুররা বাড়ি ফেরার সময় গিন্নিমা তাদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন । পৌষ পার্বণে গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে এসে সুস্বাদু খাবার খেয়ে প্রবাসী ছেলে মেয়ে ও নাতি নাতনীরা আনন্দে আপ্লুত হয় । সকলে হই হই করে বের হয় , মোবাইলে বন্দি করে সর্ষে ফুল ভরা ক্ষেত, সারি বদ্ধ আলু ক্ষেত ।
সন্ধ্যের সময় পাড়ার ছেলেরা গান গেয়ে দরজায় পিঠে চাইতে আসে , বাড়ির ছেলে মেয়েরা তাদের হাতে পুলি পিঠে দেয় ।

<<Prev1234Next>>

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com