ছোটগল্প - ঘরে ফেরা
এবার পুজোর ছুটিতে নীতা তার পরিবার নিয়ে বেনারসে ছুটি কাটাতে যায়। এবারের বেনারস ভ্রমণ, তার জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে ,সে কল্পনাও করেনি। এর আগে অনেক বার তারা বেনারস এসেছে ।নীতার দুই ছেলেমেয়ে মিলি, নিলয় ও হাজবেন্ড কৌশিক কে নিয়ে তার সংসার। নীতা ,কৌশিক দুজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করে। দুজনের চাকরি ,ছেলে- মেয়ের স্কুল এর মাঝে সময় পেলেই তারা ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। ষষ্ঠী থেকে নবমী ওখানেই থাকবে ,দশমীতে ফিরবে। বেনারস তার খুব পছন্দের শহর ,এখানকার আধ্যাতিকতা ,মন্দির ,ঘাট , খাবার, শাড়ি সবকিছুই আর ভালো লাগে। তাইতো এখানে বারবার আসে ।এবার নীতাদের হোটেল অসি ঘাটের খুব কাছেই। ওর সব ঘাট ঘুরতেই খুব ভালো লাগে, এক- এক ঘাট যেন এক- এক কথা বলে। কিন্তু ও মণিকর্ণিকা ঘাট ও হরিশচন্দ্র ঘাট এড়িয়ে চলে, মৃত দেহ দেখতে পারে না। কেমন অস্থির আর অন্ধকার লাগে। কোন ছোট বয়সে ওর মা মারা গেছে, তবু মৃত্যু ,শ্মশানঘাট এগুলো দেখলেই ওর সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। তখন ওর বয়স কত -সবে দশ, এগারো হবে। দুরারোগ্য ক্যান্সার তার মাকে কেড়ে নেয়। সেই কষ্ট ও আজও বহন করে চলেছে । ছেলে- মেয়ে কৌশিক বিভোর হয়ে ঘুমোচ্ছে। তাই নীতা আর ওদের ডাকে না ।অসি ঘাটের খুব কাছেই হোটেল হওয়াতে নীতা, একাই ভোরবেলায় গঙ্গা আরতি দেখার জন্য বেরিয়ে যায়। ভোরের সূর্য ওঠা দেখা ও গঙ্গা আরতি দুটোই তার খুব ভালো লাগে। ভোরের গঙ্গা পাড়ের শান্ত- স্নিগ্ধ পরিবেশ এক অন্য মাত্রা আনে। তার সাথে সূর্য যখন একটু একটু করে দৃশ্যমান হয় ,চারিদিকটা তখন কেমন নরম কমলা রং ধারণ করে। অপূর্ব তার শোভা, তার সাথে গঙ্গা আরতি । নীতা বিভোর হয়ে দেখে! ও এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি ,দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক- ভদ্র মহিলা তাকে অপার বিস্ময়ে দেখছে। তারা অপলক তার দিকে চেয়ে আছে। এতে খুব অস্বস্তি হয় তার। তা সত্ত্বেও যখন দেখেন ভদ্র মহিলার হাতের ব্যাগটি পড়ে গেছে এবং তা উনি খেয়াল করেননি ,নীতা তখন এগিয়ে যায়। ব্যাগটি তুলে বলে -মা আপনার ব্যাগ পড়ে গেছে। মনের অজান্তেই মা কথাটি বেরিয়ে যায়। এই কথা শুনে সীমা দেবী নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেন না ,তার চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। পাশে থাকা তার স্বামী অরুণবাবু ,উনিও খুব বীহ্বল হয়ে পড়েন। নীতা কিছুই বুঝতে পারে না ,কেন তাদের এই কষ্ট। তার ও খুব খারাপ লাগতে থাকে। আসলে এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মৌলি, ষোলো বছর বয়সে একদিনের জ্বরে তাদের ছেড়ে চলে যায় এই অষ্টমীর দিনে। অরুণবাবু নিজে ডাক্তার হওয়া সত্বেও মেয়ে কে বাঁচাতে পারেনি। বলা যায় চিকিৎসার কোনো সুযোগই পায়নি । সেই থেকে তারা দুর্গা পুজো এলেই কলকাতাতে থাকে না, পালিয়ে বেড়ায় । আজ এত বছর হয়ে গেল , একই রকম আছে। আজ দুর্গাষ্টমী ,আজ মৌলির চলে যাওয়ার দিন। আজকের দিনটা তাদের কেমন কাটে ,তা তো একমাত্র ভগবানই জানেন। কিন্তু একি !বাবা বিশ্বনাথ যে অবিকল তাদের মেয়ে মৌলির মতো একটি মেয়েকে তাদের কাছে পাঠিয়েছে। সেই মুখশ্রী !সেই গায়ের রং! অবিকল তাদের মেয়ের মত দেখতে। আজ বেঁচে থাকলে মৌলি ও এই বয়সী হতো। নীতা ওখান থেকে সরে আসতে চাইলে সীমা দেবী তার হাত চেপে ধরেন। তিনি নিজেকে আর ঠিক করতে পারেন না ,অঝোরে কাঁদতে থাকেন। নীতা কারণ জানতে চাইলে অরুন বাবু তাকে সব খুলে বলেন। সব শুনে ও খুব আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। তার ও চোখে জল এসে যায়। এই শূন্যতা তো তারও আছে ,
মাকে হারানোর শূন্যতা। আজ বিজয়া দশমী ,তারা বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পূজো দিয়ে একসাথে কলকাতায় ফেরে। আজ আর সীমা দেবী ,অরুণ বাবুর মন আর ভারাক্রান্ত নয় ,মেয়ের সাথে নাতি -নাতনি ,জামাই সবাইকে পেয়েছেন। তারা অনেক হাসি মজা করতে করতে ঘরে ফেরে। দেখে মনে হচ্ছে তারা একই পরিবার এবং এতদিন এই ভাবেই এক সাথে ছিলেন। এখন আর সীমা দেবী ,অরুণ বাবুকে একা থাকতে হয় না ,তাদের সব প্রয়োজনে , অপ্রয়োজনে তারা তাদের মেয়েকে কাছে পায়। এ বছর আবার এলো দুর্গা পূজা, না এবার আর সীমা দেবী, অরুণবাবু কোথাও যাচ্ছেন না। আজ সেই মহা অষ্টমী। সিমা দেবী নীতাকে সঙ্গে নিয়ে পূজোর অঞ্জলি দিতে আসে। তার মায়ের প্রতি আজ আর কোন অভিমান নাই। বরং তার প্রতি ,মায়ের করুণায় তার চোখে জল এসে যায়। নীতা তার চোখের জল মুছে দেয় তার ।