Logo
logo

গল্প / কাহিনী

গল্প - অন্য কোজাগরী

কলকাতার মত আলোকোজ্জ্বল শহরের হৃদয়ে নাকি আজও বেঁচে আছে সোনাগাছির সেই অন্ধকার, ক্লান্ত গলিগুলি। যেন সময়ের ঘষা লেগে আরও কিছুটা আহত অথচ শুকনো এবং পুরোনো এক অমলিন ক্ষতচিহ্ন। ভাবা যায়? সরু পথ, সোঁদা আর ঘুপচি বাতাস, পঙ্কিল ধুলো, সস্তা আতরের গন্ধে মিশে থাকে প্রতিদিনের অব্যক্ত এক বিষণ্ণতা।

তবু বছরে কয়েকটা দিন তো আসেই, যেই দিনগুলিতে অন্ধকারও যেন আলোকে গায়ে মাখতে চায়, আলোর ছোঁয়ায় জীবনের পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে চায়। আজ তেমনই অনন্য এক দিন, অন্য বস্তাপঁচা একঘেয়ে দিনগুলির তুলনায় বেশ কিছুটা দীপ্ত, খানিক বেশিই জীবন্ত। আজ তো কোজাগরী গৃহলক্ষ্মী পূজার পূণ্য লগ্ন। আকাশে কি সুন্দর রুপোর থালার মতো ঝলমল করছে পূর্ণিমার দীপ্তিময় চাঁদ, তার স্নিগ্ধ আলোয় নিষিদ্ধ - বদ্ধ গলিগুলিও আজ যেন নতুন করে নিশ্বাস নিচ্ছে।

বছরের এ এক রাত্রে যেন নিষিদ্ধপল্লীর বুকেও ছড়িয়ে পরে এক নীরব হীরক - খচিত জোৎস্না। কিন্তু তা বলে গৃহ লক্ষ্মীর পুজো? রসিকতার ন্যায় শোনালো তো? তা তো শোনাবেই ! যাদের নিজের পরিচয়টুকুই নেই, মন নেই, মান নেই , "গৃহ " বলে তো একেবারেই কিছু নেই, তারা আবার গৃহলক্ষ্মীর পূজার্চনা করবে কেমন করে? এসব তাদের মত নিঃস্বদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। তবুও লোভ হয়। পরিশেষে সবাই তো মানুষ। একটা পরিপাটি গৃহের লোভ হয়, লাল টুকটুকে বেনারসী পরিহিতা কনে-বউ সাজার লোভ হয়, চন্দনের টিপ পরে মাথা ভর্তি সিঁদুর দিতে লোভ হয়, নির্ঝঞ্ঝাট সুখময় সংসারের লোভ হয়, হইহই করে গৃহলক্ষীকে পুজো করার লোভ হয়। কিন্তু অভাব সব কিছুই কেড়ে তাদেরকে নিঃস্ব করেছে! এই অভাব তাদের সব লোভকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। সব কিছুই তো হারিয়ে ফেলেছে ওরা। অবশিষ্ট শরীর টুকুও! তাই সব লোভ সামলে উঠলেও, একটু বিলাসিতা করে লক্ষ্মী পুজোর দিন আনন্দ উপভোগ করার এই লোভটা আর সামলে উঠতে পারেনি এই বছর। তাই প্রতিরাতে ঘণ্টার পর ঘন্টা দৈহিক খাটুনির পর, হাজার কষ্ট, আত্মগ্লানি, ঘৃণা বুকে চেপে রেখে ; হাজার কাটাছেঁড়ার পরেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে - রাতের মজলিশে নিজেকে বিক্রি করে, দিনের বেলা খর জোগাড় করতে বেরিয়েছিল ওরা। বাঁশ-ছাউনি টেনে ওরা নিজেরাই গড়ে তুলেছে নিজেদের অস্থায়ী মন্দির। তাদের নিজেদের ছোট্ট লক্ষ্মী ভিটে।

সেখানেই আজ মৃন্ময়ী মা কমলার পূজা হবে।

সুলেখা জ্বির নয় বছরের মেয়ে রেখা সারারাত মা কে কাছে পায়না। একলা ভয় লাগে অন্ধকার ঘরে। তবুও মায়ের কথামত মুখ বুঁজে চুপ করে শুয়ে থাকে। ধীরে ধীরে নিশ্বাস নেয়। আওয়াজ করেনা। সুলেখা মানুষ চেনে , তাই মানুষরূপী জন্তুদের থেকে মেয়েকে শতহস্ত দূরে রাখবে বলে একেবারে কালকুঠুরির মত একটা ঘরে বন্ধ করে রাখে। সকাল হলে যখন হায়নাদের ক্ষুদা নিবারণ হয়, ওরা জঙ্গলে ফিরে যায় ... তখন সে মেয়েকে বাইরে বের করে আনে। রেখা ক্লান্ত মায়ের মাথায় তেল দিতে দিতে একদিন বলেছিল- "মা, ম্যায়নে গৌরী মৌসি কো বলতে হুয়ে শুনা হে কি - কোজাগরীতে, রক্তমাংসের মায়ের হাত ধরে মৃন্ময়ী মা প্রবেশ করেন প্রতি গৃহে। "

" মা , আমাদের তো খুদকা গৃহ না আছে, বসতি আছে, লক্সমী মা আসবে তুমার হাত পকার কে? লোকে বলে আমাদের তো জাত নেই, জানাম নেই - বেজন্মা বলে সোবাই। মা জাত কি আছে?"

প্রত্যুত্তরে সুলেখা বলল - " ধুর, পাগল, জাত হল একটা লাইন যেরকম দৌড়ানোর খেলা খেললে তুই আর মাহী দিদি মাটিতে লাইন আঁকিস। সেরকম। তোর লাইনে মাহী দিদি দৌঁড়ায় না। আর মাহী দিদির লাইনে তুই যাস না। .... এভাবেই আমাদের সমাজ ও লাইন টেনে ভাগ করে দিয়েছে সবাইকে। তবে মায়ের আবার জাত হয় নাকি? না লক্ষ্মী মায়ের জাত হয় আর না তোর মায়ের ! কোনো মায়ের জাত আলাদা নয়।সবাই মেয়ে। আর মেয়ে মানেই হলো মায়ের জাত। বুঝলি? তোকে যে বুকের দুধ দিয়ে বড় করেছি, আমি মা নই? আমার জাত হল মায়ের জাত, লক্ষ্মীও নিজে এত মানুষের মা। তাই সে নিশ্চয় আসবে আমার হাত ধরে। তোর গৌরী মওসি একদম ঠিক কথা বলে ! "

মা সব বাড়ি আসেন, প্রবেশ করেন প্রতিটি ক্লান্ত হৃদয়ে। সঙ্গে বয়ে আনেন আলো, আশার কিঞ্চিৎ সুবাস, আর অন্তত একরাতের জন্য হলেও বিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন, যে এই অন্ধকারের শেষেও একদিন ঠিক প্রভাতের নরম আলো উদিত হবে।

"বেশ্যা"পাড়ায় গলির একদম শেষ মাথায় একটা ভাঙাচোরা স্যাঁতস্যাঁতে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণে পরিবৃত ছোট্ট ঘর। সেখানেই থাকে মেঘলা, ভারী শৌখিন একখানা নাম না? আসলে যেদিন ও জন্মেছে সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা, সামান্য ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। তাই ওর নাম মেঘলা। মেঘলা হলেও সেদিন ছিল গুমোট গরম। তার মধ্যে রঙচটা নোংরা ঘরটা যেন গিলে খাচ্ছে প্রসবযন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মেঘলার মাকে।

মেঘলা শহরের কুখ্যাত নটী এবং নামজাদা যৌনকর্মী গৌরীর একমাত্র মেয়ে। গৌরীর দাম "শরীরের বাজারে" সব থেকে বেশী। বছর চব্বিশের গৌরীর যৌবনে কত পুরুষ উন্মত্ত। গৌরীর মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, স্বর্ণাভ গায়ের রঙ,ভরাট নিতম্ব ও সুডৌল স্তনের ছোঁয়া কেবল শহুরে বাবুদের সুখ দিয়ে গেছে এতকাল। সে কারণে নিজের মেয়ের মুখেই দুগ্ধামৃতের স্বাদ তার আর তুলে দেওয়া হয়নি। প্রসব যন্ত্রণা ওঠার আগের সময় অবধি গৌরী নিজেকে বিলিয়ে গেছে ক'টা টাকার জন্য। অন্ত্বসত্বা অবস্থায় ঘনঘন সহবাসের কারণে জন্ম থেকেই মেঘলা সেরিব্রাল পালসি বলে একটি কঠিন অসুখে ভোগে। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় মাতৃদুগ্ধ সেবন না হওয়ার ফলে মেঘলা অপুষ্টিরও শিকার। তবু মেঘলার মুখে ভুবনমোহিনী সেই নিষ্পাপ শিশুসুলভ হাসি। কিন্তু শরীরের গঠন যেন প্রকৃতির এক নির্মম পরিহাস। ওর হাত কাঁপে নিরন্তর, আর বাঁ পাটা অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে থাকে। তবু চোখদুটো — আহা, সেই চোখদুটোতে যেন আশ্চর্য এক দীপ্তি! যেন কারও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সেখানে নীরবে প্রতিফলিত হয়ে আছে।

নিষিদ্ধপল্লীর অনতিদূরে অবস্থিত শোভাবাজার রাজবাড়ী লাগোয়া একটি বাড়িতে থাকেন ভবেন্দ্রনাথ বানুজ্জ্যে। ভবেন্দ্রনাথ বাবু "সে পাড়া" র মোটামুটি পরিচিত খদ্দের। বিত্তবান, সুশ্রী, বলিষ্ঠ। সেখানে সকলেই এক কথায় ওনাকে চেনে। বানুজ্জ্যে বাড়িতে দুর্গা পুজো হয় ধুমধাম করে। মা আসেন উমা রূপে। ভবেনের মেজ নাতি রথীন, রথীন্দ্রনাথ, বয়স চার কি পাঁচ। ফি বছরের ন্যায় এবারও ক'দিন আগেই দুর্গাষষ্ঠীতে সব্বার প্রিয় ঢাকি কাকু এসেছিলেন, রথীন্দ্রদের বনেদী বাড়ির উমা পুজোয় ঢাক বাজাতে। ঢাকি কাকুকে ওরা প্রায় প্রতি বছরই বায়না করে। আগে ঢাকি কাকুর বাবা, দাদু এনারা ঢাক বাজাতেন। এখন দায়িত্ব কাকুর ওপরেই। বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এই বায়নার প্রথা। "বেপাড়ার" মেয়ে গৌরী প্রায় বছর চৌদ্দ থেকেই দেখেছে এই কাকুকে ভবেন্দ্রনাথ বানুজ্জ্যেদের বাড়ি প্রতিবছর ঢাক বাজাতে। গৌরী তাই সে থেকেই বানুজ্জ্যে বাড়ির কচিকাঁচাদের মুখে শুনে শুনে বাদ্যকরকে "ঢাকি কাকু" বলেই সম্বোধন করে। গৌরী আসলে প্রায় অনেক বছর ধরেই রথীন্দ্রদের বাড়ির "উমা" পুজোয় প্রতিমা গড়ার জন্য পতিতালয়ের মাটি সরবরাহ করে। এছাড়াও ভবেন্দ্র বাবুকে কে না চেনে? গৌরীর বয়স যখন উনিশ, তখনই স্ত্রী বিয়োগ হওয়ার পর ভবেন তাকে ছুঁয়েছে বেশ কয়েকবার। তারপর বাবুর বয়স বাড়ায়, দরকার মত হাঁটুর বয়সী গৌরীকে উনি ডেকে নেন রাত্রিবিলাসে। সেই সবকিছুর সুবাদেই ঢাকি কাকুর সাথেও অল্প বিস্তর চেনা শোনা হয়ে গেছে আর কি!

গৌরীর ভাগ্যখানাও বলিহারি! সেই কোন ছোট্ট বেলায় হতভাগ্য গৌরীকে ওর প্রাণাধিক প্রিয় দুই দাদা রাখীর দিন এই চরম অন্ধকারে বরাবরের মত বেঁচে দিয়ে চলে গিয়েছিল। আর ফিরে তাকায়নি তারা। ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় গৌরীর বাবা মা দুজনেই গত হওয়ার ঠিক কিছুদিন পরেই ঘটেছিল এই ঘটনা। চৌদ্দ থেকে চব্বিশ। প্রায় এক দশক। তাই সুভাষ কাকু ওকে প্রায় বড় হতে দেখেছে বললেই চলে। তবে ঢাকি কাকুর আসল নাম কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ঢাকি কাকু দুগ্গা পুজো থেকে একেবারে লক্ষ্মী পুজো অবধি কাটিয়ে, দেদার ঢাক বাজিয়ে তারপর নিজ গ্রামে ফিরে যান। প্রতি বছর ঢাকি কাকু সঙ্গে করে তার ছেলে নবীনকে নিয়ে ঢাক বাজাতে আসেন, কিন্তু এবার কেন জানিনা একাই এসেছিলেন।

হঠাৎ গৌরী দেখল দশমীর দিন কাকু তড়িঘড়ি করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিচ্ছেন ...

“ কাকু, কি গো এবার এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছ গো ?” — খপাত খপাত করে পান চিবোতে চিবোতে গৌরী জিজ্ঞেস করায় সুভাষ উত্তর করলেন — “ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা রে। তাই ও ব্যাটা আসেনি। জানিসই তো, ছোট থেকেই ওর মা নেই, বাপ-ব্যাটায় সব করি। ছেলেটা কদিন একা হাতে রেঁধে বেড়ে খাচ্ছে। তাই ছুটছি লো। দুদিন থাকলে হবে নে।”

সুভাষের কথায় স্পষ্ট ব্যস্ততা বোঝা গেলো। গৌরীও তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে নিজের পুটুলিতে কি যেন একটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।

গৌরী, এই পুজো ক'দিন রাত্তিরে গোঁসাই বাবুদের নৃত্যসভায় "বাইজি নাচ" করে বড় গোঁসাইয়ের কাছ থেকে বেশ ভালো রকমের ইনাম আদায় করেছে। ও হেসে সেই টাকার অর্ধেক ঢাকি কাকুর হাতে দিয়ে, বলল- “আচ্ছা কাকু, পরের বার ফিরলে মিষ্টি নিয়ে আসবে কিন্তু। নবীন, আহা সেই আমাদের ছোট্ট ছেলেটা নাকি মাধ্যমিক পাশ দেবে বলে কথা! ”


সুভাষ কাকু এক মুখ হাসি নিয়ে বললেন - “এইবার মা চাইলে, আমি তোদের সকলের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসব লো। অনেক আশা জানিস, ছেলেটা ফি বছর ফাস্টো হয়। আশীর্বাদ কর লো তোরা সবাই , যেন এবার মাধ্যমিকে ওর নাম কাগজে বের হয়। ”

কাকুর সেদিনের সেই প্রাণোচ্ছ্বল হাসিটা যেন আজও গলির দেয়ালে রয়ে গেছে। কিন্তু পরের বছর কাকু আর ফেরেনি। এরম তো আগে একবারও হয়নি। বন্যা, দুর্যোগ সব মিটিয়েও কাকু এসেছে আগে। কিন্তু এই দুর্গা পুজোয় কাকু আর আসেনি... মিষ্টি নিয়ে তো কাকুর আসার কথা ছিল, তবে? গৌরী জানত না, যে কাকুর সেই হাসি থেমে গেছে অচিরেই।

কয়েক সপ্তাহ পর খবর এলো অবশেষে। সুভাষের দূর সম্পর্কের এক ভাইপো চূড়ান্ত শোকের খবর বয়ে নিয়ে এসে হাজির হল রথীন্দ্রদের বাড়ির পুজো দালানে। সেই দুঃসংবাদ খুব কম সময়ে চাউর হল এদিক ওদিক। শোনা গেল, ঢাকি কাকুর একমাত্র আদরের ছেলে নবীন, মাধ্যমিকে ভীষন ভালো ফলাফল করে ভর্তি নিয়েছিল গ্রামেরই এক উচ্চবিদ্যালয়ে। বরাবরই নবীনের ইচ্ছে ছিল কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে গ্রামের কৃষকদের উপকার করবে সে।

সে বছরই বিশ্বকর্মা পুজোর পরের দিন দুপুরবেলা তাদের নিজেদের ধান ক্ষেতে বাকিদের সাথেই ওই টুকটাক কাজ করছিল নবীন। জানতে পারা গেলো, সেখানেই একটি বিষাক্ত সাপের কামড়ে সে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছে। নাহ, সে যাত্রায় তাকে আর তাদের কুলদেবী মা মনসাও বাঁচাতে পারেননি। প্রথমে স্ত্রী, তারপর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোকে সুভাষ যেন ক্ষয়ে যেতে লেগেছেন ভেতর থেকে। সে যেন আর কিছুতেই ঢাক বাজাতে পারেন না। ঢাকের আওয়াজে তার নিজের বুকের কান্না মিশে থাকে।

খবরটি শোনার পর গৌরী সেদিন আর কোনো খদ্দের নেয়নি। খুব কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। মেঘলা কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনুভব করেছিল সন্তান হারিয়ে ফেলার ভয় আসলে কি! গৌরীর ভয় হয়, মেয়েকে না সে পিতৃপরিচয় দিতে পেরেছে, না দিয়েছে স্বাভাবিক জীবন। তার মধ্যে মেয়ের এই রুগ্ন অসুস্থ শরীর। তাই যে পথে সে রোজগার করছে, সে পথ মেঘলার জন্য নিঃসন্দেহে বন্ধ। মেঘলা কি খাবে? পড়বে যে, তার খরচ কি ভাবে চালানো যাবে?কোথায় থাকবে সে? এই চিন্তা যে কিছুতেই কাটে না গৌরীর। হঠাৎ এসব ছাই পাশ ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো সুভাষ ঢাকির কথা! গৌরী নিজের মনেই কোথাও না কোথাও ঠিক জানত যে গৌরীর প্রতি সুভাষ কাকুর স্নেহ ছিল অপার, নিখাদ — যদিও রক্তের সম্পর্ক নয়, কিন্তু সেই স্নেহে পিতৃত্বের মমতা মিশে থাকতো। গৌরী না থাকলেও তাই সে নিশ্চয় মেঘলাকে দেখবে। এমনিও কাকু সন্তানহারা পিতা, গৌরী কি একবার মেঘলার কথা টা বলে দেখবে? কিন্তু একটা .... দোটানায় পড়েছে গৌরী! ইতস্তত লাগছে ।

তবুও, কাকু তো আগের বারও পুজোতে এসে মেঘলার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,

“ডরিস না লো মা, তোকে দেখে মনে হয়, এই গলির মধ্যে একটুকরো আলো বুঝি তোর জন্যই বেঁচে আছে।”
এত বড় কথা সে বলেছে, মেঘলাকে সুভাষ কাকু নিজের নাতনী ব্যতীত অন্য কিছু মনে করতেন না। যতবারই কাকু এসেছে এখানে, রক্তজল করা পরিশ্রমী বৃদ্ধ কাঁপা হাতেই কাকু মেঘলাকে আদর করতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, কিছুক্ষণ কোলে রাখতেন। মেঘলাকে দেখে সুভাষ কাকুর বরাবরই মায়া হত।

মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বয়স দুই তিন হল। অমন সুন্দর দেখতে কিন্তু না চলতে পারে ভালো করে, না মুখে কথা ফোটে পরিষ্কার। কি যে এক প্রগাঢ় সমস্যা!

কিন্তু শুকনো শিরার ভারে জর্জরিত জরাজীর্ণ এই চেহারায় নিজেরই একবেলা পেটে ভাত পরেনা, মেঘলার চিকিৎসার জন্য বহুল খরচের দায়িত্ব তিনি আর কি ভাবেই বা নেবেন ?

নবীন চলে যাওয়ার দু বছর হল। ছেলের মৃত্যুর দুবছর পর কাকু, এবছর ফের পুজোয় ফিরেছিলেন রথীন্দ্রদের উমা পুজোয়। কাকুর থাকার কথা ছিল লক্ষ্মীপুজোর দিন অবধিই। ঠিক যেমনটা প্রতিবার হয়। উমাপুজোর পর পর ঢাক নিয়ে কাকু অন্যান্য পাড়ায় মুড়ি- চিড়ে চাইতে বের হন। ঢাক বাজিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে দু এক পয়সা বাড়তি কামাই হয় এই পুজোর দিনেই। নচেৎ সেই কষ্ট করেই সারাবছর দিনযাপন করতে হয়। তারপর শুরু হয় লক্ষ্মীপূজায় ঢাক বাজানোর তোড়জোড়।

এদিকে প্রতিবছর লক্ষ্মী পুজো নিয়ে উন্মাদনা থাকে নিষিদ্ধ গলিগুলিতে। এবারও তাই ছিল। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর ঠিক দু’দিন আগেই গলির নিস্তব্ধ আকাশে নামল এক পৈশাচিক ঝড়। মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু ভেসে গেল বিশৃঙ্খলার অন্ধ ঘূর্ণিতে। এক মায়ের পূজার আগমুহূর্তে অন্য এক মায়ের দেহ ভেসে গেল রক্তে। মানুষের ছদ্মবেশে পশুরূপী নরপিশাচেরা ছিঁড়ে খাবলে খেল গৌরীর মাংস, নিংড়ে নিল ওর শেষ নিঃশ্বাস। সেই অভিশপ্ত রাত্রে, তিনজন ধনী বাবুর হিংস্র লালসায় দগ্ধ হয়ে, ধর্ষিত হয়ে গৌরী শেষমেশ মৃত্যুকেও আপন করে নিল — যেন পৃথিবীর অন্যায়ের সমস্ত ভার নিজের দেহে বহন করে মুক্তির পথ বেছে নিল সে।
নাহ! কোন মামলা রুজু হয়নি, হয়নি মোকদ্দমা.... কিছুই হল না এই খুনের। কোন কিনারাই হল না। নষ্ট মেয়েদের আবার ধর্ষণ কি? এই নীচ সমাজে তাদের যে বিচার পাওয়া মানা। ছোট্ট মেঘলা দরজার আড়ালে বসে, মায়ের নিথর ঠাণ্ডা শক্ত হাত বুকে চেপে, এক মনে- মাথা গুঁজে খুব কাঁদছিল। কিছু একটা বেশ বলতে চাইছিল মা কে, কিন্তু কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিল না। ধীরে ধীরে রাত কেটে ভোর হল...

পরদিন সকালে পাড়ার সবার কাছে খবর পেয়ে ঢাকি কাকু ছুটে এলেন গলির সেই পরিত্যক্ত নিষিদ্ধ বাড়িতে। আজ মেয়েদের প্রত্যেকের কাজে ভাটা পরবে - খাবারও জুটবে না হয়তো দুই তিন দিন । এসব কিছু জেনেও সমস্ত মেয়েরা কাঁদছে গৌরীর পাশে দাঁড়িয়ে, সুলেখার কোলে ওর মাথা। কেউ ওকে পায়ে পরিয়ে দিচ্ছে আলতা, কেউ রাতের চিরাচরিত সাজ চাপিয়ে দিচ্ছে ওর দেহে। কামড়ানো অর্ধেক খেয়ে ফেলা ঠোঁট দুটো দুমড়ে মুচড়ে এক সার। তবুও শেষবারের মত একটু রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে কেউ। মেঘলা যদিও এক কোণে বসে থর-থর করে কাঁপছে। সুভাষ কাকু এসব দেখে তখন নেহাতই বুদ্ধিভ্রষ্ঠ , কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না। তবুও নিজেকে কিছুটা সামলে মেঘলার মাথায় হাত রেখে বললেন -

“ভয় কি মা, আমি আছি তো। তুই এখন থেকে আমার একার মেয়ে, আমার সাথেই থাকবি।”

মেয়েটা ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়েছিল একটু ক্ষণের জন্য। তারপর গোধূলিতে মেঘলার ওই ছোট্ট দুটো খানিক বাঁকা হাত, কুশ কাঠি করে আগুন ধরিয়ে দিল আর্তনাদ ও যন্ত্রণায় মলিন হয়ে যাওয়া ওর মায়ের মুখে।

পরেরদিন রাত্তিরে কোজাগরী পূর্ণিমাতে লক্ষ্মীপুজোর তিথি। সেবারও পুজো হওয়ার কথা ছিল, জোগাড় প্রায় হয়েই গেছিল। কুমোরপাড়া থেকে প্রতিমাও চলে এসেছিল। বাকি ছিল শুধু চক্ষুদান আর পায়ে পতিতালয়ের মাটি বুলানো। কিন্তু এই শোকস্তব্ধ পরিস্থিতিতে আর কি পুজো হবে? অন্যান্য পাড়ার মত রঙচঙে আলো এবার আর গলিতে জ্বলল না, গমগমে মাইকের কান ফাটানো অত্যাচারের বালাও নেই, ঢাকের বাদ্যিও বাজলো না এবার। কারণ সুভাষ কাকুর মন ভারী খারাপ। নবীন চলে যাওয়ার পর গৌরী তাকে পিতার মত করে শ্রদ্ধা করত। যত্ন-আত্তি করত। সেও চলে গেলো। যাকেই জড়িয়ে ধরতে চাওয়া হয় বেশি করে ... সেই যেন চলে যায় অনেক দূরে। আর ফিরে আসেনা। "তবু চলে যেতে দিতে হয়" !

চোখের জল মুছতে মুছতে অনেক কিছু ভেবে চিন্তে, অবশেষে লক্ষ্মী পুজোর দিন সাত সকালে বস্তিতে গিয়ে, বুকে পাথর চাপা দিয়েই, অসুস্থ মনমরা মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে সকল অধিবাদীবৃন্দকে একটু আশ্বস্ত করে সুভাষ বললেন -
- “এ বছরও মা কমলা আসবেন। চিন্তা নেই।তোমাদের বস্তিতেও আসবেন মা লক্ষ্মী।”

থমথমে পরিবেশ। তবুও গলির সমস্ত যৌনকর্মীরা মিলে পতিতা গৌরীর বাড়ির মাটি কেটে নিয়ে এলো। পতিতালয় থেকে কেটে এনে দলা করা সেই মাটিতেই তৈরি হল এবারের লক্ষ্মী প্রতিমার ডান দিকের পায়ের পাতা , রঙ করা হলো, পরানো হল আলতা— শহুরে বাবু ও তাদের স্ত্রীরা রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার পথে রঙ্গ করে ফি বছরের মতই বললেন “বেশ্যা বাড়ির ঝিতে, লক্ষ্মী গড়ে কি তে?” ....... "কালে কালে কত কি হল, পুলি পিঠের ন্যাজ গজালো"..... ইত্যাদি, প্রভৃতি।

তবে সেসব আকথা কুকথায় কর্ণপাত করল না কেউই। মায়ের উন্মুক্ত দেহে পরানো হল কাপড়, সাজানো হল ঝলমলে গহনা দিয়ে। মাটির প্রদীপ দিয়ে সাজানো হল দালান, আলপনা দিল মেয়েরা। সুভাষ কাকু বানুজ্জ্যে বাড়ির পুজোর কাজ একপ্রকার ফেলে দিয়েই ছুটে এলেন বস্তিতে। এবার কাকু উমা পুজোর পর আবারও মন খুলে, প্রাণ ঢেলে ঢাক বাজালেন। তার ঢাকের তালে কাঁপা হাতে মেঘলা ধুপ দিয়ে আরতি করলো প্রতিমাকে, ফুল দিল প্রতিমার রাঙা পায়ে। কাকু ওমনি উৎফুল্ল হয়ে , ঢাকখানা নামিয়ে রেখে , আহ্লাদী মেঘলাকে কোলে তুলে নিলেন। মেঘলার মুখে হাসি যেন আর বাঁধ মানে না। মেঘনা সুভাষ কাকুর এই ব্যবহারে একটু অবাক হল ঠিকই, কারণ "বাবা" শব্দটার সাথে , পিতৃস্নেহের সাথে তার পরিচয় তো একেবারেই নেই। তবুও মেঘলা এই অচেনা নতুন স্নেহ অনুভব করে ভারী আনন্দ পেল। অনেক দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও যেন এবারের লক্ষ্মী পুজো হল পরিপূর্ণ। পুজো হল সাধ্যমতো ঘটা করেই। হয়তো বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ পুজো করা সম্ভবপর হয়নি কোনোকালে, তবে অসীম আন্তরিকতা থাকে এই পুজোতে। সব নটীরা নিজেদের সমস্ত উপার্জন, সমস্ত সামর্থ্য উজাড় করে পুজো করেন, তবে এবার যেন ছিল কান্না, দুঃখ, প্রতিবাদের তীক্ষ্ণ সুর - সবটাই গৌরীকে করা সম্মানের উপলক্ষে। আড়ম্বরহীন এই পুজোর এমন প্রচার ঘটলো যে পুজোর ভাসানে শোভাবাজার ঘাটে বড় বাড়ির বাবুরা-বৌঠাকুরাণীরা এসে দাঁড়িয়ে মায়ের প্রতিমা দেখে গিয়েছিল। সেদিন কেউ কটূক্তি করে হাসেনি, কেউ নিন্দেমন্দ করেনি — সবাই কেবল নিঃশব্দে দেখল, মা কমলা যেন সত্যিই জাতের বিচার করেন না। মা এসেছেন সবার মাঝে। মা চলে গেলেন স্বর্গে। নিজস্থানে । ভাসানের অবকাশে সহস্রাধিক ধূপ ও ধুনোর ধোঁয়ায় ভেসে উঠল গৌরীর মুখ, তারপর ঢাকি কাকুর ছোট্ট ছেলে নবীনের মুখ — দুজনেই যেন পরম আশীর্বাদ করছে প্রাণ ভরে মেঘলা আর সুভাষ কাকুকে।

রাত্তিরে সমস্ত কাজের শেষে, ঢাকি কাকু মেঘলাকে সাথে নিয়ে রথীন্দ্রদের বাড়ির দিকে রওনা হলেন। সেখানেই ওকে একটি ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেলেন। যেখানে ঢাকি কাকু ফি বছর এসে থাকেন। কাকু মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললেন-
“জানিস মা, আমার ছেলে যেভাবে ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে দেখত, তুইও ঠিক তেমন করেই যেন আমাকে দেখিস। তুই যখন নিজ হাতে প্রতিমার পায়ে পুষ্প নিবেদন করলি, মনে হল স্বয়ং মা কমলা তোর হাতে পুজো নিতে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। তুই আজ প্রমাণ করে দিয়েছিস মা, তুই এই গলির আলো, তুই-ই আমার আসল পুজোর প্রতিমা। ওই যে তোকে কত্ত আগে বলেছিলাম। ”

মেঘলার চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠলো অশ্রুতে। আগে কখনও তাকে কেউ এত কাছে টেনে এনে ভালোবেসে দুটি কথা বলেনি। কই এতো ভালো তো তার মধ্যে আর কেউ দেখে নি। তাই সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট ভাবেই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলো -

“আমি তো ঢাক বাজাতে পারি না দাদান, কিন্তু আমি তোমার পুজোর জন্য অনেক ফুল তুলে এনে দেব, খাবার বানিয়ে দেবো পাতা দিয়ে— যতদিন হাঁটতে পারবো।”
মেঘলা রান্নাবাটিতে কতবার পাতা কেটে লুচি বানিয়ে মা কে খাইয়েছে। সেই হিসাবেই ও নিজের টুকু আর দাদুর জন্য পর্যাপ্ত রান্না করে নিতে পারবে । সুভাষ কাকু মেঘলার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। মাথায় অনেক করে হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন কোলেই।

পরদিন রাত্তিরে যখন পাড়ায় পাড়ায় ঢাকের আওয়াজ সম্পূর্ণ থেমে গেছে, আলোকসজ্জা স্তম্ভিত হয়ে গেছে, আবার সেই অন্ধকার গলিতে নিয়মিত খদ্দেরের ভিড় বাড়ছে দরজায় দরজায় ; তখন সুভাষ বুঝলেন এবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে তার। সুভাষ কাকু ব্যাগপত্র গুছিয়ে মেঘলাকে নিয়ে ভোর হওয়ার আগেই শেষ রাতে চলে গেলেন। কেউ জানলো না, তারা কোথায় গেল —শুধু প্রতিমার পায়ের কাছে একটা ছোট থলি রেখে গেলেন সুভাষ। ভিতরে তিন চার বাক্স নারকেলের মিষ্টি — আর চিরকুটে লেখা -

“তোদের সবার মা তোদের মধ্যেই আছেন রে। তো ঠিক খুঁজে পাবিই পাবি। দেখিস। ভালো থাকিস। আর প্রতিবছর লক্ষ্মী পুজো করিস। তোরাই লক্ষ্মী। তোদের মধ্যেই লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান।

– ইতি তোদের ঢাকি কাকু।”


বিশ বছর পর, আবারও কাল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। নিষিদ্ধ পল্লীতে লক্ষ্মী পুজোর বিশেষ তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে গেছে।

সবাই এখন এক ডাকে “গৌরিবাড়ির লক্ষ্মী প্রতিমা" চেনে। প্রতি বছর মেঘলার মত আরও অনেক ছোট্ট "আলো"রা কাঁপা হাতে প্রতিমার সামনে ধূপ জ্বালে, কপালে এঁকে নেয় নিজের ভবিষ্যতের সোপান। সুভাষ কাকু আর ঢাক বাজায় না — তবু বাতাসে আজও স্মৃতি - স্নেহ মিলে মিশে থাকে। উৎসব হয়। নানাবিধ অনুষ্ঠান হয়। মেঘলারা আলো বয়ে আনে। মা আলো বয়ে আনেন। এ যেন এক অন্য কোজাগরী !

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com