Logo
logo

গল্প / কাহিনী

কেয়া পাতার নৌকা

বেশ কিছুদিন যাবৎ রুষ্ট প্রকৃতি তার লেলিহান অগ্নিবাণে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দিনের তাপমাত্রা ৪০° পর্যন্ত পৌঁছেছে। শুষ্ক ধরিত্রী আকন্ঠ পিপাসায় তার ধমনী কাঁপিয়ে জেগে উঠেছে রক্তচক্ষু মেলে। নির্বাপিত চিতাগ্নির জনশূন্য ভূমিতে কালের বক্ষ ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে নিদারুণ হাহাকার পরিব্যাপ্ত আকাশের বুকে উন্মত্ত জলপরীদের মিথ্যা অবগাহন। সমাজের বুকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মানুষ থেকে পশুকূল আজ অসহায়। বৃক্ষনিধন থেকে জলাশয়, আজ লোভাতুর মানুষের গ্রাসে। আকাশচুম্বী অট্টালিকায় পাথরের জঙ্গলে ভরে যাচ্ছে গ্রাম থেকে শহর। প্রকৃতিকে শুষ্ক করার জন্য ঘরে ঘরে এ.সি র দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে প্রতিদিন। এমনি রুক্ষ দিনে মানুষ যখন বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে, তখন আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানিয়ে দেয় বৃষ্টির পূর্বাভাস। সকাল থেকেই পূবালী হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রথমে টুকটাক, পরে ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হলো। বহুদিনের প্রতীক্ষার পর এই বারিধারা মানুষের মনে আনন্দ এনে দেয়। আমি ঘুম থেকে উঠে সুন্দর একটা বৃষ্টি ভেজা সকাল পেয়ে খুব খুশি হলাম। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ জলের ঝাপটা আমার সারা শরীর ভিজিয়ে দিল, আমি এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করলাম। বৃষ্টির দাপটে বড় বড় গাছগুলো আনন্দে একে অন্যকে আলিঙ্গন করতে চাইছে।
দূরের মাঠঘাট কিছুক্ষণের মধ্যেই জল থইথই অবস্থা। বৃষ্টির সাথে ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগলো, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি। দূরে কোথাও বজ্রপাত হল। আমিও ভয় পেয়ে ঘরে চলে গেলাম। জানলার কাঁচে জলের আঁকিবুঁকি দেখতে লাগলাম। বাড়ির পাশে আমগাছটায় একটা কাক বসে ডাকতে লাগল। সকালের জলখাবারে নারকেল মুড়ি আর সাথে বেগুনী দিনটিকে আরও মধুময় করে তুললো। বৃষ্টির সাথে শৈশবের একটা যোগাযোগ আছে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে পরে যায় ছোটবেলায় কাগজের নৌকা ভাসানো, নোংরা জলে হুটোপুটি আর ঠাকুমার কাছে ভূতের গল্প শোনার কথা। এমনি বৃষ্টি ভেজা দিনে আমি গুনগুন করে গেয়ে উঠি-
"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে।"

আমি নীচে গিয়ে দেখলাম বজ্রপাতের ফলে বিদ্যুত চলে গেছে। দুপুরের খাবারে খিচুড়ির তোড়জোড় করতে করতে খবর এল পাশের পাড়ার একজন এগারো বছরের বাচ্চা ছেলে জলে নেমে খেলা করার সময় ছেঁড়া তারে হাত লেগে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে তার দাদাও আহত হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাচ্চাটিকে বাঁচানো‌ যায়নি। তার দাদা আপাতত সুস্থ আছে। খবরটা শুনে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। প্রকৃতির রোষে বলি হতে হল ছোট্ট বাচ্চাটাকে। ক্রমাগত বৃষ্টিতে পথঘাট সব জলমগ্ন হয়ে পরল। বাড়ির সকলে খিচুড়ি, ডিম ভাজা, চাটনি পাঁপড় খেয়ে ঘরে চলে গেল। আমি হাতের কাজ গুছিয়ে বৃষ্টিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করব বলে বাড়ির কাছে কামিনী ফুলের গাছটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শ্বেতশুভ্র পুষ্পরাজি বৃক্ষতলে বিছিয়ে রয়েছে। আমি আকাশের পানে চেয়ে বৃষ্টির অপরূপ লীলা দেখতে লাগলাম। আমার সর্বাঙ্গ বৃষ্টির স্নেহ চুম্বনে ছুঁয়ে যেতে লাগল। এই বৃষ্টি আমার সুখ-দুঃখ, বেদনা-যন্ত্রনা, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব গুলোকে মুছে দিতে যায় প্রতি বর্ষনে।
বৃষ্টির সাথে আমার সখ্যতা শৈশব কাল থেকে। আমি দুচোখ বন্ধ করে স্বপ্নের ভেলায় চড়ে ভেসে যাই শৈশবের আঙিনায়। তাই বৃষ্টির দিনে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে কোনো গ্রাম্য মেঠো আলপথ ধরে, যেখানে সবুজের হাতছানি।
বৃষ্টির জলে নুইয়ে পড়ে ধানের শীষে জলবিন্দু, দীঘির কালো জলে রূপালী মাছের মিছিল। আটচালার ঠাকুর দালানে অন্ধ বৈরাগীর বাউল গানের সুর মনকে মাতাল করে দেয়। কখনো ভরা বর্ষনে, পাহাড়ি নদী যখন উদ্দাম গতিতে যৌবনা রমনীর ন্যায় আছড়ে পড়ে সাগর বক্ষে, সেই দৃশ্য দেখতে ইচ্ছা করে। বৃষ্টি ভেজা দিনে প্রিয় মানুষের হাত ধরে অজানা পথে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো চুল আর ভিজে পোশাক সামলাতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য আজও মনে পড়ে। নদী বক্ষে মাছ ধরার নৌকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে দূরের পানে চলে যেতে দেখতে ইচ্ছা করে। আকাশের পানে তাকিয়ে বৃষ্টির সাথে নিজেকে একাত্ম করে স্বপ্নের জগতে ভেসে যেতে যেতে এক অনাবিল আনন্দ মনকে আনন্দে ভরে তোলে। সন্ধ্যা নামার মুখে আমার স্বপ্নতরী নোঙর করে বাস্তবের মাটিতে। গোধূলি বেলায় শান্ত ধরিত্রী সদ্যস্নাত বধূটির ন্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে এসে দাঁড়ায়। তার ললাটে রক্ততিলক জ্বলজ্বল করছে। শতশত নক্ষত্ররা আলোক মালায় সেজে স্বর্গ রথে চড়ে চলে যায় অনন্তলোকে। আমি একাকী বৃষ্টিকে উপভোগ করতে থাকি, শরীর আর মনের সমস্ত শিরা উপশিরায়। সহসা বিদ্যুত চমকে সম্বিত ফিরে পাই। জীবনের অনেকটা চড়াই উতরাই পার করে স্মৃতির সাগরে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাই। দু'চোখ
মেলে দেখি আমি একাকী কামিনী ফুলের বিছানো শুভ্র চাদরে দাঁড়িয়ে আছি, আমার শরীর জুড়ে মিষ্টি ফুলের গন্ধ। মনে এক পবিত্র সুখানুভূতি অনুভব করে শৈশবের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে ফিরে আসি বাস্তবে।।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com