Logo
logo

গল্প / কাহিনী

বর্ষণে অতীত কুড়িটা বছর

ঈপ্সিতা তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পরে।আষাঢ় মাসের ২৮ তারিখ, সেদিন উল্টোরথযাত্রা, ওর জন্মদিন। জ্যেঠু, দাদা, দিদি, দিদা, মামা, মাসি সকলেই ওদের বাড়িতে। ছোট বেলা মহোৎসবেই জন্মদিনটা পালন করা হতো।সকালবেলা আকাশ পরিষ্কার ছিলো। হরেক রকমের রান্না।লোক জন, রান্নার লোক, কাজের লোক। একেবারে ভরপুর বাড়ি। বাড়িতে একটা বড় আঙিনা ছিল। মাধবীলতা, বেলি, গোলাপ,জুঁই ফুল। পাশে রয়েছে কদম ফুল । অভিনন্দন জানাচ্ছে আজ ইতুর জন্মদিন। স্নান সেরে দুপুরে নতুন একটা স্কার্ট মিডি পরে সব ভাইবোনেদের সাথে ইতু বসে ছিলো । এক এক জন করে মাথায় ধান দূর্বা এবং উপহার দিয়ে আশীর্বাদ পর্ব চলছে। খাওয়ার পরে বাড়ীর সকলে মিলে গল্পে মশগুল।বিকেলের গরম চা আর সিঙ্গার নিয়ে হাজির হলো সিধু কাকা। প্রায় সাড়ে চারটা নাগাদ ঠিক হলো পাশের পাড়াতে সাধন জ্যেঠুর বাড়ি, সেখানে রথের মেলা দেখতে যাবে ঈপ্সিতা । সযত্নে জ্যেঠু তাকে নিয়ে আসে। বলেছিলেন "বৌমা, ইতুকে তাড়াতাড়ি দিয়ে যাবো।"ঈপ্সিতার ডাক নামটি ছিল ইতু। সে আবার একটা নতুন জামা পরে জ্যেঠুর সাথে গেলো । সাজতে ইতু খুব ভালোবাসে। এদিকে সন্ধ্যা বাড়তে লাগলো বলে ওর ফুলমাসি তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে থেকে গেলো। বাকিরা আস্তে আস্তে নিজেদের গৃহে গমন করতে লাগলো। এমনিতেই সোজা রথযাত্রার দিন মেলা তাড়াতাড়ি বসতে থাকে। কিন্তু উল্টো রথেরদিন আস্তে আস্তে সবই বসলো। ফুচকার দোকান, ঘুগনি, পাঁপড় ভাজা, গজা, চপ, গরম গরম জিলিপি। মাটির হরেক রকমের পুতুল, প্লাস্টিকের পুতুল। হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া উঠলো, তারপর বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি হতে শুরু করলো। জ্যেঠুর বাড়ীর বাইরের বারান্দায় বসে মেলা দেখা যায়। ঈপ্সিতাও মনোযোগ সহকারে মেলা দেখছিল। একটু বৃষ্টি থামতেই জ্যেঠুকে নিয়ে মেলায় নেমে পড়লো, একটা পায়ের জুতো কখন হারিয়ে গেছে খেয়াল নেই।অনেক পুতুল কিনেছিলো। কিন্তু তার মধ্যে জ্যেঠু একটা নীল রঙের নাড়ুগোপাল কিনে দিয়েছিল। ওই পাড়াতেই থাকতো বরুণ নামের একটি ছেলে। ঈপ্সিতার জ্যেঠুর অফিসেই কাজ করে। বরুণও তার বাবার সাথে বেরিয়েছে রথের মেলা দেখতে। বরুণও একটি নাড়ুগোপাল নিলো।প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সাধন বাবু ঈপ্সিতাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে গেলেন ছাতা মাথায় দিয়ে ।রাস্তায় জল জমেছে প্রায় এক হাঁটু। রাত্রি সাড়ে আটটা বাজতে চললো। বিদ্যুতের ঝলক, মেঘের কড়কড় শব্দে ইতু প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাচ্ছিলো। এক হাতে নাড়ুগোপাল আর এক হাতে জ্যেঠুর গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কোনোরকমে এক হাঁটু জল পেরিয়ে বাড়িতে এলো। ইতুর জ্যেঠু প্রথমেই বলে দিলো "বৌমা আমার ইতুমাকে বোকো না।"রাতে ইতুর প্রচন্ড জ্বর এলো। চুপ করে নাড়ুগোপাল নিয়ে খেলতে লাগলো। কয়েকদিন পরে সুস্থ হয়ে ওঠে। এদিকে সাধন বাবুর সহকর্মী অসিতবাবুর শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। যা আয় করেন তাতে বৌয়ের চিকিৎসা করাতে ঠিকমতো পারছিলেন না। প্রায় বছর তিনেক পর তিনি মারা যান । বরুণ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় এবং পাসও করে। ইতুর জ্যেঠুই খেয়াল রাখতো। এক সময় অসিত বাবুও মারা গেলেন। কিন্তু ইতু প্রতিবছর জ্যেঠুর কাছ থেকে উল্টো রথের দিন নাড়ুগোপাল নিতো। জ্যেঠু আবার বরুণকেও কিনে দিতো ও তাতেই খুশি হতো। ইতু বলে একদিন, "তুমি কী করবে এটা নিয়ে ?" বরুণ বলে "এটা জ্যেঠুর ভালোবাসা। তাই নিয়ে নি।"ইতু একটু মিচকি হাসে। ছোট বেলা ওদের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু কৈশোর কালে সেটা তাদের নিজেদের অজান্তেই কখন যেন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যায়।কিন্তু কেউই কাউকে কিছু বলে উঠতে পারে নি। ওদের ভালোবাসা ভস্মের নীচে চাপা পরে গিয়েছিলো।পরবর্তী কালে নিজেদের পড়াশোনা, চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত। বরুণ চাকুরী সূত্রে মুম্বাইতে ছিল। নতুন বিয়ে করেছে। প্রতিদিনের মতো সেই দিনও দুপুরবেলা তাঁর স্ত্রী ইরাকে ফোন করে বলে আজকে তারা রাত্রে বাইরে ডিনার করবে। অফিস থেকে ফেরার পথে ২৬শে নভেম্বর সেই দুর্বিসহ সন্ধ্যার সময় জঙ্গীদের আক্রমনের সময় বরুণ আহত হয় এবং তার বাম পা টি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। দুটো চোখের দৃষ্টি শক্তি ঝাপসা। ইরার বাবা প্রশাসনের সহায়তায় তাড়াতাড়ি করে একমাত্র মেয়ে ও জামাতাকে নিয়ে আসেন। সেই তখন থেকেই ইরা স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতেই থাকে। ঈপ্সিতার ও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সাধন জ্যেঠুও মারা গিয়েছেন। প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা, বরুণ ও ঈপ্সিতা দুজনেই দুজনকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, তবুও স্মৃতিপটের কোথাও যেন একটা হালকা ছবি ছিল। একদিন হঠাৎ ঈপ্সিতা বাজার করতে গিয়েছিলো আর একই দোকান থেকে ইরা জিনিস কিনছিল। ঈপ্সিতার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা মাটিতে পরে যায় ইরার পায়ের কাছে। ইরা তুলে ঈপ্সিতাকে দেয়। এইখান থেকে আলাপচারিতা হয় দুজনের। ইরা ঈপ্সিতাকে একদিন বাড়িতে আসতে বলে। দুজনের বাড়িতো সেই একই পাড়ায়।এই ভাবেই দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যায়। ঈপ্সিতার ছেলে ব্যাঙ্গালোরে সবে চাকুরী পেয়েছে। ফোনেই কথাবার্তা।সেইদিন ছিলো উল্টো রথযাত্রা। ঈপ্সিতার শ্বশুরবাড়ীর সামনে বড় রাস্তায় রথের মেলা বসে বহু বছর আগে থেকে। ঈপ্সিতার ঘরের পাশে ব্যালকনিটা বেশ সুন্দর। খোলা নীল আকাশ, রোদ, বৃষ্টি, মেলা কিংবা দূর্গা পুজো বেশ ভালো করে উপভোগ করা যায়। সেইদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। দুপুরে একটু খেয়ালখুশি মতো বাড়ীর আঙিনায় বৃষ্টিতে ভিজলো। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঈপ্সিতার স্বামী রণজয় হেসে বললো "পঞ্চাশ তো পেরিয়ে গেছে ইতু এখনো ছেলেমানুষি করছো, জ্বর হলে বুঝতে পারবে।" কথাগুলো শুনে ইতু একটু যেন লজ্জা পেলো। "ধ্যাৎ তাই বলে কী বৃষ্টিতে ভেজা বারণ?"দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ব্যালকনিতে একটা চেয়ারে বসে দেখছিলো ভেজা রাস্তায় উল্টোরথের মেলা বসতে শুরু করেছে। ওর তখন শৈশবকালের মেলার কথা মনে পরে যাচ্ছিলো। চুপচাপ বসে শৈশবকালের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বরুণের কথা মনে পরে যায়। ভেসে উঠতে লাগলো পুরনো অনেক স্মৃতি। চোখে কোণ জলে ভরে উঠলো। রণজয় ঈপ্সিতার জন্মদিন পালন করে নিজের পরিবারের সকলের সাথে। সেইদিন কী মনে হলো সন্ধ্যার পরে রাস্তার পাশে মেলায় একটু ঘুরতেই ইরার সাথে দেখা। ইরা মেয়েকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে। একটু গল্প করতে করতে ইরা কী ভেবে বলল, "ঈপ্সিতাদি চল আজকে আমার বাড়ি , ওই যে সবুজ রঙের বাড়িটা।" ইতু বললো "আজকে থাক অন্য একদিন আসবো।" কিন্তু ইরার মেয়েটি খুব মিষ্টি দেখতে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। নাম এনাক্ষী । এদিকে ইরা খুব জোড়াজুড়ি করায় আর না বলতে পারলো না। চলল ইরার সাথে। দুই বান্ধবীর কথাবার্তার মাঝে চায়ের পেয়ালা এলো। ইরা দোতলায় নিয়ে গেলো সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো। ইরার ঠাকুর ঘরটি খুব সুন্দর। একটি গোপাল বসানো রয়েছে সিংহাসনে। তার স্বামী একটা ঘরের এক কোণে একটা হুইল চেয়ারে বসে রয়েছে। বাম পা টা নেই। কিন্তু কয়েকটা নাড়ুগোপাল ছিল আলমারিতে সাজানো। ইরা পরিচয় করিয়ে দিতেই ঈপ্সিতা চমকে উঠলো। একটা অস্পষ্ট কথা ঈপ্সিতার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু বোঝা গেলো না। বরুণ,ঈপ্সিতা দুটো ব্যক্তি অতিপরিচিত হলেও আজ তাঁরা সমাজের কাছে অপরিচিত ব্যক্তি।
আজকে সেই উল্টোরথ, সেইবৃষ্টি, সেই রথের মেলারমাঝে কেটে গিয়েছে কুড়িটা বছর। কুড়িটা বর্ষাকাল। ফেলে আসা সেই অতীতের স্মৃতির বয়সও কুড়িটা বছর। ছলছল চোখে ঈপ্সিতা বেরিয়ে এলো। মাটির পুতুলের দোকানে সেই নীল নাড়ু গোপাল দেখতে পেলো না ঠিক মতো। মনে হলো যেন হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া আর মুষলধারে বৃষ্টিতে সব কিছু ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। প্রাণপন চেষ্টা করে তাকে ধরে রাখতে পারলো না।তবুও বরুণের আর ইরার মঙ্গল কামনা করল সর্ব শক্তিমানের কাছে।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com