গল্প - চাঁদের হাট
বাংলার গ্রামঞ্চলগুলোতে পরিবার এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এক অনন্য সংস্কৃতির অংশ। এখানে যে কোনো বড় ধরনের পারিবারিক অনুষ্ঠান একটি সামাজিক উদযাপনে পরিণত হয়। ঠিক তেমনই একটি দিন ছিল আমার দাদানের (ঠাকুরদা) ৮০ তম জন্মদিন।
ফুলবাড়ী গ্রামের বাড়িটি এক পুরোনো দালান, যেখানে অজস্র স্মৃতি ও ভালোবাসার ইতিহাস জমে আছে। এই বাড়িটিতে প্রতি বছরই নানা উপলক্ষ্যে মিলিত হতো পরিবারের সকল সদস্য, কিন্তু ১৯৯৫ সালের ১২ই জুলাই দাদানের ৮০তম জন্মদিন ছিল একেবারেই বিশেষ। বাড়ির আঙিনা, উঠোন, এবং আশেপাশের এলাকা যেন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠেছিল।
দাদানের জন্মদিনের কয়েক দিন আগে থেকেই বাড়িতে এক বিশেষ উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। দাদানের জন্মদিনের এই বিশাল আয়োজনের জন্য আমরা সবাই অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করেছিলাম।
আষাঢ়ের আকাশে মেঘ জমলেও, বাড়ির ভেতরে উচ্ছ্বাসের ঢেউ ছিল অপ্রতিরোধ্য। বাড়ির বড় বড় দরজা-জানালা খোলা রেখে, প্রত্যেকটি কক্ষ সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। মা, কাকিমনি পিপিরা সবাই মিলে বাড়ির অন্দর - সংসারের সাজ সজ্জায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকা হয়, রঙিন কাগজের ঝালর এবং ফুল দিয়ে গোটা বাড়ি সাজানো হয়।গন্ধরাজ আর বেলি ফুলের মালায় চারিদিকটা যেন এক নতুন দিগন্তের ছোঁয়া পেয়েছিল। অন্যদিকে আমি আর ছড়দা ( জ্যেঠুর ছোট ছেলে)বেলুন ফোলানো নিয়ে মেতে ছিলাম। আর রাঙাদির( পিপির মেয়ে) কাজ ছিল সেই বেলুন গুলো সুতো দিয়ে বাঁধা। আবার গোটা বাড়ির বাইরেটা আলো দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব ছিল ছোটকার উপর। যেন সমস্ত গ্রামটাকে সাজিয়ে তুলেছিল এক নতুন রূপে। সবাই যেন অপেক্ষায় ছিল এই মহা দিনের জন্য।
সকাল থেকেই বাড়ির ভেতরে ছিল হাঁকডাক। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, গ্রামের সকলেই একত্রিত হয়েছিল দাদানের আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য। দাদান যিনি নিজেও ছিলেন খুবই উৎসাহিত, গায়ে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন বাড়ির পুরোনো পালঙ্কে। দাদানের মুখে সেই অমলিন হাসি, যা তার জীবনের সংগ্রাম আর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
সকালে গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত এসে দাদানের আশীর্বাদ এবং পূজো সম্পন্ন করেছিলেন। আমরা সবাই মিলে মন্ত্র উচ্চারণ করে দাদানের দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলাম।
বাজারের দায়িত্বে ছিলেন বাবা, জ্যেঠু, আর ছোট পিসাই। আর এদিকে রান্নাবান্নার দায়িত্বে ছিলেন মা, কাকিমনি , জেম্মা আর পিপি ( পিসি)। গ্রাম্য প্রথা অনুযায়ী, গ্রামের অনেকেই আগেভাগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। কেউ ঘর সাজাতে, কেউ রান্নার কাজে, আবার কেউ বা বাজারের কাজে। এই সহযোগিতা শুধু কাজের ভাগাভাগি নয়, বরং পারিবারিক বন্ধনের একটি উদাহরণ।
জন্মদিনের মূল আকর্ষণ ছিল বাড়ির পুকুর পাড়ে আয়োজিত এক বিশাল ভোজনের অনুষ্ঠান। বড় বড় পাত্রে সাজিয়ে রাখা খাবারের মধ্যে ছিল লুচি, আলুর দম, বেগুন ভাজা, পোলাও, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, পায়েস, মিষ্টি, আর কত রকমারি পদ। সেই খাবারের গন্ধে গোটা বাড়ি যেন এক ভোজ্য বাগানে পরিণত হয়েছিল। দাদানের খাবার সুন্দর করে কাঁসার থালায় সাজিয়ে পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন বড় বৌমনি ( জ্যেঠুর বড় বৌমা) আর তিতলি (ছোটকার মেয়ে)। সবাই মিলে এক সাথে বসে খাওয়া এটি একটি সামাজিক সংযোগের প্রতীকও বটে। সবাই এক সাথে মিলেমিশে খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছিলেন।পরিবারের ছোটরা বিশেষভাবে খুশি ছিল, কারণ তাদের হাতে ছিল ঢাক বাজানোর দায়িত্ব। ঢাকের তালে তালে বাড়ির সকলেই নেচে উঠেছিল আনন্দে।
সন্ধ্যায় আয়োজিত হয়েছিল এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দাদানের পুরোনো দিনের গানগুলো আবার নতুন করে পরিবেশন করা হয়েছিল। সবার মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলো, যখন দাদান তার মিষ্টি কণ্ঠে গান গেয়ে সকলকে মুগ্ধ করতেন। গ্রামের বাচ্চারা তাদের নাচ-গান পরিবেশন করেছিল, যা দাদানের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। দাদান তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে তখন অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন - তাঁর যৌবনের দিন, কীভাবে তিনি এই গ্রামে নিজের পরিশ্রমে একটি অবস্থান তৈরি করেছিলেন, এবং কীভাবে জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিলেন। তাঁর কথায় আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। আর ছিল গ্রামের নাট্যদলের একটি বিশেষ নাটক, যেখানে গ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল । দাদান বলেছিলেন, " এগুলো আমার আসল ধন - তোমাদের ভালবাসা আর এই গ্রামের ঐতিহ্য "।
গ্রামের মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামের মানুষদের সাথে আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তাই তাদের ছাড়া এই আয়োজন অসম্পূর্ণ হতো। দাদানের কিছু শৈশবের সঙ্গীও এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। দাদান তখন সবাইকে বলেছিলেন, " এই দিনটা আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর দিন, তোমাদের সবার ভালবাসা আর আশীর্বাদে আমি সত্যি ধন্য"।
দাদানের ৮০তম জন্মদিনের উদযাপন ছিল পরিবারের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। পুরো বাড়িটা যেন একটা চাঁদের হাটে পরিণত হয়েছিল। বাড়ির প্রতিটি কোণে ছিল খুশির ঝলকানি, আর দাদানের চোখে ছিল সন্তুষ্টির অশ্রু। তিনি এক মুহূর্তের জন্য ফিরে গিয়েছিলেন তার পুরোনো দিনগুলিতে, যখন তার আশেপাশে ছিল ভালোবাসা আর আনন্দের সমাহার। সেইদিনের রাতের আকাশে বড় এক পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল, যা যেন ছিল দাদানের জীবনের প্রতীক—পরিপূর্ণ ও আলোয় ভরা।
যখন রাতের শেষ প্রহর নেমে এলো, তখনও যেন সেই চাঁদের হাটের আলো আমাদের হৃদয়ে আলো করে রেখেছিল।ফুলবাড়ীর বাড়ি সেইদিন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এক মহা উৎসবে, যা সকলের মনে গেঁথে থাকবে চিরদিন।