বিসর্জন
বর্ষা। শব্দটা শুনলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে, প্রকৃতির অপরূপ সজ্জা যেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা পরে, বৃষ্টির শব্দে সমস্ত পৃথিবী যেন সংগীতময় হয়ে ওঠে। এই বর্ষা একদিকে আমাদের মনের আনন্দের উৎস হিসেবে দেখা যায়, আবার অন্যদিকে বিষাদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
গ্রামের নাম সুখপুর। শান্ত,সবুজ আর নিবিড় এক জায়গা। সারা বছর জুড়েই সেখানে একটা নিরিবিলি ভাব বিরাজ করে। তবে বর্ষা এলে গ্রামটিতে এক অন্যরকম রূপ লেগে যায়।
প্রতিবছর বর্ষার শুরুতেই আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি নিয়ে শুরু হয় বৃষ্টির আগমনী বার্তা। গ্রামের মানুষদের মধ্যে তখন এক ধরনের উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়। সবাই যেন এই বর্ষার জন্যই অপেক্ষায় থাকে।
শিশুরা কাদামাটিতে খেলে, যুবকরা ফুটবল খেলে আর বয়স্করা পুকুরের ধারে বসে গল্প করে। গ্রামের ছোট ছোট স্কুলের ছেলেমেয়েরাতো বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে নাচতে থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক রকম আনন্দের ভেলায় ভাসে।
গ্রামের নাম সুখপুর, কিন্তু এবার সুখকে গ্রাস করেছে দুঃখের কালো ছায়া। বর্ষার প্রথম দিনে বৃষ্টি ছিল মৃদু, সবাই আনন্দে মেতেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই প্রকৃতি তার খেয়ালিপনায় শুরু করল বৃষ্টির ধারা। টানা তিনদিন ধরে থেমে থেমে চলতে থাকল বৃষ্টি। গ্রামবাসীরা ভাবলেন, হয়তো এই বৃষ্টি ফসলের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
চতুর্থ দিন থেকেই প্রকৃতির ভিন্ন রূপ দেখা গেল। নেমে এল ঝোড়ো হাওয়া আর অনবরত বৃষ্টি। জল বাড়তে থাকল, পুকুর-নালা সব ছাপিয়ে গেল। গ্রামের প্রধান রাস্তা বন্যায় ডুবে গেল। লোকজন আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো।
হরিপদর পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তারা ছিল দরিদ্র কৃষক পরিবার। হরিপদ, তার স্ত্রী মালা আর দুই সন্তান নিয়ে তাদের ছোট্ট বাড়িটাই ছিল তাদের সবকিছু। জমিতে কাজ করে তারা কোনমতে জীবনযাপন করত। কিন্তু এবার বর্ষা তাদের সবকিছু কেড়ে নিতে প্রস্তুত। হরিপদ তার সন্তানদের নিয়ে উঠে গেল পাশের স্কুলে, যেটা এখন শেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্কুলে আশ্রয় নেওয়া বহু মানুষ সেখানেই দিন কাটাতে শুরু করল। কিন্তু খাবার আর বিশুদ্ধ জলের অভাবে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে লাগল। গ্রামবাসীরা আশা করছিলেন সরকার থেকে সাহায্য আসবে, কিন্তু বন্যার ব্যাপকতার কারণে সাহায্য পৌঁছাতে দেরি হচ্ছিল।
একদিন গভীর রাতে হরিপদ আর তার সন্তানরা ঘুমিয়ে ছিল, মালা ঘরের বাইরে বসে ছিলেন। হঠাৎ করেই এক বিশাল ঢেউ এসে স্কুল ভবনের দেয়াল ভেঙে দেয়। মালা চিৎকার করে উঠল, "হরি, বাঁচাও!" কিন্তু সবকিছু এত দ্রুত ঘটল যে হরিপদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জল এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
পরের দিন সকালে, বন্যার জল কিছুটা নেমে গেলে, গ্রামবাসীরা খুঁজতে শুরু করল তাদের প্রিয়জনদের। হরিপদ তখনও জানত না তার পরিবার কোথায়। ঘন্টাখানেক পর, এক আত্মীয় এসে জানাল যে মালার দেহ নদীর কচুরিপানার মাঝে পাওয়া গেছে। হরিপদের মনে যেন আকাশ ভেঙে পরল।
সবাই মিলে মালাকে শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত করল। গ্রামের পুরোহিত এসে শেষকৃত্যের কাজ সম্পন্ন করলেন। হরিপদর চোখের জলে ভরে উঠল, তার প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা তাকে ভেঙে ফেলল।
এই বর্ষার বিষাদ যেন পুরো গ্রামকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বর্ষা, যা একসময় আনন্দ আর শান্তি নিয়ে আসত, এবার সে নিয়ে এল বিষাদের ঢেউ। সুখপুরের গ্রামবাসীরা এবার উপলব্ধি করল যে, প্রকৃতির রূপ সবসময় মধুর নয়, কখনও কখনও তা হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর ও নির্দয়। বর্ষার এই দ্বৈত প্রতিফলন আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবন কখনোই শুধুমাত্র আনন্দ বা শুধুমাত্র বিষাদে সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষার মতো, জীবনও বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে পূর্ণ।