বৃষ্টি দেখতে পাহাড়ে
কিছু কিছু মুহূর্তের আবেদন মানুষের জীবনে গভীরতর। স্মৃতির চিত্রপটে তা আঁকা থাকে পরম যত্নে। সেদিনের বর্ষণমুখর দিনটিও আমার হৃদয়পটে দাগ কেটেছে। প্রবল বর্ষণ মুখরিত সেই দিন স্ব - মহিমায় স্বাতন্ত্র আর বৈচিত্র্য নিয়ে আমার মনকে করে তুলেছিল ব্যাকুল। প্রকৃতির বুকে বর্ষা এসেছে অনেক আগেই। তবুও বর্ষার সেই দিনটি অন্যরকম একটা শিহরণ নিয়ে আমার অনুভুতিতে সাড়া জাগিয়েছিল। বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে বেরিয়ে পরলাম আমি আর আমার দুই বান্ধবী, রাকা আর তহ্নি। গন্তব্য বাঘমুন্ডি, পুরুলিয়া। শহরে বৃষ্টি দেখেছি, কিন্তু শহরের প্রকৃতি পাহাড়ের প্রকৃতির মত অত নিবিড়ভাবে মনকে স্পর্শ করেনা। তাই পাহাড়ি এলাকায় বর্ষণ মুখর দিন কাটানো ছিল আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। বর্ষার দিনে পাহাড়ে যাওয়ার রোমাঞ্চ আমাদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা যোগ করেছিল। দিনটি ছিল ২০শে জুলাই ২০০২। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে যাত্রা শুরু হলো। জানালার বাইরে মেঘলা আকাশ, বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধ আর রেলগাড়ির ছন্দময় ঝাঁকুনি, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি সাড়া জাগিয়েছিল আমাদের সকলের মনের গহীনে।
খুব সকালে ট্রেন এসে থামল পুরুলিয়া ইস্টেশনে। রাস্তায় জলখাবার সেরে একটি গাড়ি ভাড়া করে আমরা তিনজন রওনা দিলাম গন্তব্য স্থলে। সকাল থেকেই মেঘগুলো আকাশে দখল নিয়ে আছে। চারিদিক যেন ধূসর পর্দায় আচ্ছন্ন। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছানোর পরই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে প্রকৃতি যেন নিজের মাধুর্য্য আর রহস্যময়তা মেলে ধরছে। আমি জানালার পাশে বসে আছি। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, দূরের পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে মেঘের চাদরে ঢাকা পরছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জানালার কাঁচে এক অসাধারণ নকশা তৈরী করছে। রাকা হাসতে হাসতে বলল, "এটাই তো চাইছিলাম!" আমরা ঠিক করলাম যে এবারে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে যাব। আমরা ছাতা খুলে পাহাড়ি পথে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের পথ পিচ্ছিল, তবুও আমাদের পা থামাতে পারেনি। চারপাশে সবুজে মোড়া পাহাড়, ছোট ছোট ঝর্ণা, পাখির কূজন আর মেঘের ভেলা আমাদের মনকে বিমোহিত করেছিল।
কিছু দূর হাঁটার পর আমরা একটি ছোট্ট চা এর দোকানের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে বসে বৃষ্টির ধারা দেখার মজাই আলাদা। তহ্নি বলল, "চা খাওয়া দরকার, নাহলে এই আবহাওয়া পুরো উপভোগ করা যাবে না।" আমরা চায়ের দোকানের মালিকের কাছে গিয়ে চা চাইলাম। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমরা একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। চা খেতে খেতে আমরা বৃষ্টির তালে তালে গল্পে, কবিতায় আর গানে মেতে উঠলাম, “মন মোর মেঘের সঙ্গী”
চায়ের সঙ্গে বৃষ্টির ধারা যেন একে অপরের পরিপূরক।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমতে আমরা আবার রওনা দিলাম। পাহাড়ি পথ ধরে আমরা একটি আদিবাসী গ্রামে পৌঁছালাম। গ্রামে ঢুকতেই আমাদের চোখে পড়ল বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে খেলা করছে, আর বড়রা দালানে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। গ্রামের মানুষের আন্তরিক অভ্যর্থনায় আমরা অভিভূত হলাম। তারা আমাদের তাদের ঘরে ডেকে নিল, আমাদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেনি।
গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলে আমরা জানতে পারলাম তাদের জীবনের নানা গল্প। এই সরল জীবন আমাদের মুগ্ধ করল। গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার পাহাড়ের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। হঠাৎই শুরু হলো বৃষ্টি। আমরা একটি বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শীতল স্পর্শ অনুভব করছিলাম। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন আমাদের মনকে নতুন করে শুদ্ধ করে দিচ্ছিল।
পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমরা সেখানে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম, মেঘের ফাঁকে সূর্যের লুকোচুরি খেলা যেন মনকে অন্য এক জগতে নিয়ে যাচ্ছিল। বৃষ্টির পর পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যাস্ত দেখার এই অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
ফেরার পথে আমরা একটি ছোট কুটিরে এসে বিশ্রাম নিলাম। তখনও হালকা বৃষ্টি পরছিল। আমরা বারান্দায় বসে গরম চা আর পিঁয়াজি হাতে নিয়ে বৃষ্টির রূপমাধুর্য্য উপভোগ করছিলাম। রাকা বলল, "এই বর্ষণমুখর দিনে পাহাড়ে এসে মনে হলো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন কাটালাম।" তহ্নি সায় দিয়ে বলল, "প্রকৃতির এই রূপ আমাদের মনকে সত্যিই নতুন করে শুদ্ধ করে দিলো।"
আমাদের মনেও প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে গেল, আর আমরা বুঝতে পারলাম যে এই পাহাড়ি বর্ষণমুখর দিন আমাদের স্মৃতির পাতায় সারাজীবন চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।