Logo
logo

গল্প / কাহিনী

কারোর পৌষমাস, কারোর সর্বনাশ

সেমন্তিনী হঠাৎই ফোন করে নাছোড় বান্দা ওর সাথে ইলিশ উৎসবে সুন্দরবন যেতে হবে, তিন দিনের জন্যে।ভালো খাওয়াদাওয়া আছে।ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।এদিকে মুষলধারায় বৃষ্টি। অনেক পথ ট্রেন,অটো করে পেরিয়ে এসে উঠে পরলাম স্টীমারে।জমজমাট পরিবেশ অনেক লোকজন, সবার সাথেই আস্তে আস্তে আলাপ জমে উঠলো।নদীর জলও পাগল পাড়া, ফুলে ফুলে তেড়ে আসছে ঢেউ।তার মধ্যেই চলে এলো আমাদের ওয়েলকাম ড্রিংক আর ইলিশের রিং পিস ভাজা।বৃষ্টির জলের গন্ধ আর নদীর দুলুনিতে ভাসতে ভাসতে ইলিশের স্বাদ আহা.... এমন সুখ, যেন স্বপ্নে ভাসছি মনে হচ্ছে।
বেশ মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেই এই স্বপ্ন পূরণ করতে হল ঠিকই।তবে তা সার্থক মনে হচ্ছে।কারণ এমন স্বপ্নে ভাসা সহজে হয় না।
সেদিনটা খেয়ে দেয়ে জল দেখে আর হৈ চৈ করে বেশ কেটে গেল।
পরদিন সকালে উঠে ব্রাশ করে চা নিয়ে বসে বসে বোটের ড্রাইভারের সাথে গল্পে মজলাম।কি সুন্দর ওদের গ্রাম আর লাইফ স্টাইল,সেসব শুনছিলাম বসে বসে।তবে ওরা বড্ড গরীব।একে তো গরীব তার উপরে প্রতি মুহূর্তে বাঘের ভয়।কখন যে পরিবারের কে বাঘের পেটে চলে যাবে কেউ জানে না।বড় দুঃখ হল এসব কথা শুনে।কত কাছ থেকে ওরা মৃত্যুকে দেখে।কি অবস্থা হয় তখন মনের!
এসব দুঃখ করতে করতে মাঝি দাদা বলল,"দিদি গো আমাদের পুরো জীবনটা বড় দুঃখের।প্রতি বর্ষায় বাণে ভেসে যায় আমাদের ঘরদোর।ছেলেপুলে,সোনায় গড়া সংসার,গরু বাছুর, হাঁস মুরগী সব কিছু গো। ভেসে যায় ফসল জমি জায়গা....
তোমরা এখানে যখন আমাকে ভালো মন্দ খাবার দাও আমার মনে হয় আমি আমার বউটাকে আর ছেলেপুলে গুলোকে এসব কখনও খেতে দিতে পারি না।কোথায় পাব গো এত টাকা? রোজের দু'বেলা দু মুঠো কোন রকমে জোগাড় করি। বেশীর ভাগ বর্ষাতে ভেসে যায় যখন সব, তখন আমাদের সরকারের ক্যাম্পে গিয়ে থাকতে হয় নিজের ঘর ছেড়ে।আর কাকেই বা নিজের ঘর বলব? বাণে তো ডুবে গিয়ে সমস্ত ভেঙে যায়।একটা তক্তোপোস কিনেছিলাম।কিন্তু আগের বর্ষাতে যখন ডুবে গেল সব,ক্যাম্প থেকে জল সরবার পরে ফিরে দেখি পচে গলে গেছে।একটা গরু ছিল।দুধটুকু বাচ্চা দুটোর মুখে দিতাম।কিন্তু বন্যায় নিজেরই থাকবার জায়গা থাকবেনা যখন বুঝলাম,শুনলাম বাণ আসছে তখন ওর দড়ি খুলে দিয়ে বললাম পালা যেখানে ভালো থাকিস চলে যা,আমি তোকে রক্ষে করতে পারলুম না।জানিনা সে বেঁচে আছে কি না।বাসন পত্র, জামা কাপড় যেটুকু আমাদের ছিল,সব ফেলে পরিবার নিয়ে ছুটলাম ক্যাম্পে।ওখানে দুবেলা চিঁড়ে, গুড়, খিচুড়ি যা দিতো তাই তুলে দিতাম পরিবারের মুখে।কোন রকমে বেঁচে ছিলাম।তারপরে যখন জল সরলো, শুরু হল ঘরে ঘরে ডায়রিয়া। সরকার থেকে বাঁশ দড়ি টিন দিয়েছিল আমাদের।তাই দিয়ে বউ আর আমি ঘর বাঁধলাম নতুন করে।সবাই তাই করলো,যারা যারা বেঁচে ফিরেছিল।অনেক জায়গা থেকে আমাদের ত্রাণ আসে।কিন্তু বলোতো দিদিভাই নিজের ঘর নিজের সংসার নিজের কামাই নিজের ফসল ভালো নাকি পরের দেওয়া ভিক্ষার অন্ন ভালো?কিন্তু এইভাবে ভিক্ষার অন্ন মাথায় নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয় গো" বলেই সে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আমাদের এবারে ফেরার পালা। মাঝি দাদার কাছে এসব কথা শুনে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল।মনে মনে ভাবলাম আমরা বর্ষায় ভিজে ভিজে একগাদা টাকা খরচ করে ইলিশ উৎসবে মাতছি প্রত্যেক বছর,অন্য দিকে এই মানুষগুলোর অনিশ্চিত জীবন যাপন।কত তফাৎ তাইনা আমাদের !!!.... আমরা ছোট বেলায় পড়েছি বইতে, বর্ষা এলে চাষীদের খুব আনন্দ তারা মাঠে নামে বীজ বুনতে।শুনেছি ভালো বর্ষা হলে ভালো ফসল ওঠে।আমরাও উপোভোগ করি বর্ষাকে,কেউ বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসি,কেউ বৃষ্টি দেখতে ভালোবাসি,কেউবা বৃষ্টি নামলে কত কবিতা লিখি।আসলে আমাদের জীবনটা সুনিশ্চিত।কিন্তু ওই মানুষগুলোর ভেসে যায় সব কিছু।বর্ষা কারোর জীবনের পৌষমাস তো কারোর জীবনের সর্বনাশ।

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com