প্রবন্ধ - দেবী দুর্গা, তার পরিবার ও পুরাণ
আমার জীবনে বড় উৎসব মানেই দুর্গাপুজো।তবে দুর্গাপুজো মানেই আমার কাছে শুধু নতুন জামাকাপড় আর আনন্দ নয়।দুর্গা পুজো মানে আমার নিজেকে সময় দেওয়া।যে সমযটাতে আমি নিজের মত করে সময কাটাতে পারি।আমার মন ছোট বেলা থেকেই কিছু জানার জন্য ব্যাকুল থাকে সবসময়।সেই রকমই একবার মা কে প্রশ্ন করেছিলাম ভগবান বলে কি সত্যি কিছু আছে? কোথায় থাকেন তারা? মা আমাকে আমার মত করে কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিল সেদিন।কিন্তু এবারে আমি পুরাণ নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছিলাম দেবী দুর্গাকে নিয়ে।যা জেনেছি সেটাই হল আজ আমার প্রবন্ধের বিষয়।
-----------------------------------------
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। কখনও তিনি মহামায়া, কখনও বা উমা। কখনও আবার মহিষাসুরমর্দিনী। এমনই বহু নামে মর্তে পূজিত হন দেবী দুর্গা। শক্তির আধার দেবী দুর্গাকে আরাধনার মাধ্যমেই প্রতিবছর শারদীয়া উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। মৃণ্ময়ীর পূজা থেকে পেটপূজা, আলোর রোশনাই, বাহারি পোশাক কোনটারই কমতি থাকে না চারদিনের সর্বজনীন এই উৎসবে। আর এই উৎসব ঘিরে রয়েছে নানা মতবাদ নানা মতামত।
দেবীর দুর্গার শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কি? সেই প্রাচীন যুগে দেবীর কনসেপ্টটা এলো কোথা থেকে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। দেবী দুর্গার ঘটনা সবচেয়ে বিশদ ভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’ (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। অন্য সব পুরাণে দেবীকে পাওয়া যায় অন্যভাবে!
তবে দুর্গা—এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি। তার দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যারা সেকেলে ধরণের ঠাকুর বানান, তাদের ঠাকুরের পিছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তারা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছর বছর দেখে আমরা অভ্যস্ত।
দেবী দুর্গা ও তার সহযোগী দেবদেবীদের নিয়ে গল্প-কাহিনির শেষ নেই। তার উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। গবেষক-পণ্ডিতগণ প্রত্যেকেই নিজের মত করে বয়ান দিয়েছেন, নিজেদের মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের মত’ বলেও কোনো কিছু গ্রহণ করার মত বাস্তবতা নেই। কোন্ মত বেশিরভাগ পণ্ডিত দ্বারা সমর্থিত-সেটাও একটা ধাঁধাঁ!
নানা সময়ে দুর্গা পূজা প্রচলনের নানা কাহিনি শোনা যায়। কালিকা পুরাণ অনুযায়ী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য দখল করেন। ব্রহ্মার বরে তিনি তখন অবধ্য। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের সমবেত তেজ থেকে যে ‘দুর্গা’ নামক নারীমূর্তি আবির্ভূত হয় সেই শক্তিই বিনাশ করে অসুরকে। ত্রেতাযুগে রাবণ চৈত্র মাসে এই পূজা করতেন। পরে পূজার নামকরণ হয়েছিল অকাল বোধন। অকালে পূজা বলেই যেন বেশি আদর। তা-ও আবার রাবণ বধের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের পূজা। পুরাণে অবশ্য এইসব বৃত্তান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।
দুর্গার সঙ্গে ‘আত্মীয়ের’ মত আরও যেসব দেবদেবী দেখা যায়-এরা হলেন, লক্ষ্মী সরস্বতী, কার্তিক গণেশ। ওপরের দিকে কখনও কখনও ছোট্ট করে শিবের মূর্তিও থাকে। প্রচলিত ধারণা আছে যে, এ যেন শিব দুর্গার সংসার, দু’পাশে তাদের চারটি ছেলেমেয়ে! এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওই চার জন মোটেই পরস্পরের ভাই বোন নন। আর, দুর্গার পক্ষেও কোনও সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ছিল না।
সরস্বতী কী করে দুর্গার মেয়ে হবেন? তিনি দুর্গার চেয়েও বয়সে বড়। সরস্বতীর দেখা পাই আমরা আমাদের সভ্যতার ঊষালগ্নে, যখন ঋক বেদ রচিত হচ্ছে। তখন যজ্ঞের সময় এক সঙ্গে তিন দেবীকে আহ্বান করা হত। ইলা, ভারতী ও সরস্বতী। এরা প্রথমে আলাদা ছিলেন, এক সময় ইলা (ইড়া) কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন, আর, ভারতীও ক্রমশ মিশে গেলেন সরস্বতীর সঙ্গে।
সরস্বতী দেবী আবার নদীরূপাও বটে। নামের অর্থেই তার পরিচয়। অবশ্য ‘সরস’ শব্দের অন্য অর্থ জ্যোতি, অর্থাৎ তিনি জ্যোতির্ময়ী। ক্রমে নদীরূপটিই প্রাধান্য পায়। সে কালে গঙ্গার উল্লেখ খুবই কম, আর্য সভ্যতায় সিন্ধু এবং সরস্বতীই দুই প্রধান নদী। সরস্বতীর তীরে বহু যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। প্রসিদ্ধ রাজারা এর দু’তীরে বাস করতেন। গড়ে উঠেছিল বহু নগর ও তীর্থস্থান।
এক সময়ে কোনও অজ্ঞাত কারণে এই সরস্বতী নদী অন্তর্হিত হয়ে যায়। পরিণত হয় মরুভূমিতে। তখন তিনি ছিলেন ধনদাত্রী, অন্নদাত্রী। ‘দানশালিনী অন্নসম্পন্না স্তোতৃবর্গের রক্ষাকারিণী সরস্বতী যেন অন্নদ্বারা সম্যক রূপে আমাদের তৃপ্তি সাধন করেন।’
সব দেবদেবীরই বিভিন্ন যুগে নানা বিবর্তন হয়েছে। ঋষিরা তো এক জায়গায় বসে, কমিটি গঠন করে দেবদেবীদের নির্দিষ্ট রূপ ও গুণাবলির কথা রচনা করেননি। নানা জনে আলাদা আলাদা ভাবে ইচ্ছে মতন শ্লোক লিখেছেন। যুগ যুগ ধরে সেই সব পৃথক ভাবমূর্তি একটি মিলিত রূপ পেয়েছে।
আজকের যে সরস্বতীকে বাক্ দেবী বলে মনে করা হয়, আদি যুগে তিনি তা ছিলেন না। নদী রূপে তিনি মানুষের অন্ন ও সম্পদবৃদ্ধির জন্য আরাধ্যা হয়েছেন। আবার, দেবীরূপে তিনি যুদ্ধও করেছেন দানবদের বিরুদ্ধে। তখন লক্ষ্মীও আসেননি, দুর্গাও আসেননি। এঁদের দু’জনের ভূমিকাও সরস্বতীকে কিছুটা পালন করতে হয়েছিল।
সরস্বতীর নানান গুণের কথা বলা হলেও তাঁর মূর্তি স্পষ্ট ছিল না। শুধু বলা হত তিনি শুভ্রবর্ণা। কালপ্রবাহে সরস্বতীর জন্ম সম্পর্কেও বিভিন্ন গল্প প্রচলিত হয়েছে। কোনও পুরাণে তিনি ব্রহ্মার কন্যা; ব্রহ্মার মুখ থেকে নির্গত হয়েছিলেন। জন্মমাত্রই যুবতী, এই কন্যার রূপ দেখে কামমোহিত ব্রহ্মা তাঁর মিলন চান। ব্রহ্মার পুত্ররা এ জন্য ছি ছি করায় ব্রহ্মা শেষ পর্যন্ত অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে আত্মহত্যাই করে বসেন! আবার, কোথাও সরস্বতীকে বলা হয়েছে পরমেষ্ঠিনী।
ব্রহ্মার অপর নাম পরমেষ্ঠী, অর্থাৎ, সরস্বতী ব্রহ্মার পত্নী। আর একটি শ্লোকে সরস্বতী বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গিনী। এবং সরস্বতী শিবেরও স্ত্রী, এমন উল্লেখও আছে। অর্থাৎ, প্রধান তিন দেবতার সঙ্গেই তার সম্পর্ক আছে। আগেই বলা হয়েছে, নানা মুনির নানা মত। তবে, বাঙালিরা কী করে এই সরস্বতীকে শিব-দুর্গার কন্যা বানিয়ে ফেলেছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
লক্ষ্মীর আগমন আর একটু পরে। অনেকেরই ধারণা, সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে আসেন লক্ষ্মী। কিন্তু, লক্ষ্মী সমুদ্রের অতলে গেলেন কী করে? এ সম্পর্কেও একটা কাহিনি আছে। দুর্বাসা মুনি, যিনি শুধু অভিশাপ দেবার জন্যই বিখ্যাত, তার অন্য কোনও গুণের কথা বিশেষ জানা যায় না, তিনি এক দিন একটা ফুলের মালা উপহার দিলেন ইন্দ্রকে।
ইন্দ্র অমন ফুলের মালা অনেক পেয়েছেন, তিনি অন্যমনস্ক ভাবে মালাটি রেখে দিলেন ঐরাবতের মস্তকে। ঐরাবতের বোধহয় মালাটি পছন্দ হয়নি, মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা সে ফেলে দিল মাটিতে। তার পর পা দিয়ে চেপ্টে দিল। ব্যস! রগচটা স্বভাবের ঋষি অমনি জ্বলে উঠে উচ্চারণ করলেন অভিশাপ। অদ্ভুত সেই অভিশাপ। তিনি বললেন, কী! আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর নির্বাসন। দোষ করলেন ইন্দ্র, শাস্তি পেতে হবে লক্ষ্মীকে। সাধে কি আর নারীবাদীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ওপর এত ক্ষিপ্ত! অগত্যা লক্ষ্মীকে লুকাতে হল সমুদ্রে।
পরে দেবতাদের ব্যাকুল প্রার্থনায় বিষ্ণু পরামর্শ দিলেন সমুদ্র মন্থনের। মন্থনের পর যিনি রত্নাকর থেকে উত্থিতা হলেন, তিনি কিন্তু লক্ষ্মী নন। সেই দেবীর নাম শ্রী। এই শ্রী ও লক্ষ্মী দুই পৃথক দেবী ছিলেন। বেশ কিছু কাল পরে দুজনে মিলেমিশে এক হয়ে যান। লক্ষ্মী দেবী ছিলেন মহর্ষি ভৃগুর কন্যা, মায়ের নাম খ্যাতি। লক্ষ্মী ও শ্রী একাকার হয়ে বিষ্ণুর পত্নী হন। সেই লক্ষ্মীই কী করে ইন্দ্রের পাশে থাকেন? এ সবই দেব দেবীদের ধারণার নানা রকম বিবর্তনের ফল।
আর দুর্গা তো কারও মা হতেই পারেন না। কয়েকটি পুরাণ মতে, তিনি শিবের স্ত্রীও নন। মহিষাসুর নামে অসুরকে ব্রহ্মা বর দিয়ে ফেলেছিলেন যে, কোনও পুরুষ তাকে বধ করতে পারবে না। এর পর সে মনের আনন্দে দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করল। উত্ত্যক্ত, ব্যতিব্যস্ত দেবতারা দেখলেন, এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। তারা নিজেরা কেউ এই দানবের সঙ্গে লড়তে পারবেন না, এক প্রবল শক্তিশালিনী নারীকে সৃষ্টি করতে হবে। তখন অনেকেই তাদের তেজের অংশ দান করলেন।
শিবের তেজে হল মুখ, বিষ্ণুর তেজে দশটি বাহু, চন্দ্রের তেজে দুই স্তন, ইন্দ্রের তেজে কোমর, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, বসুগণের তেজে আঙুল, কুবেরের তেজে নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, সন্ধ্যার তেজে দুই ভুরু ও পবনের তেজে দুই কান। এই গঠন প্রক্রিয়ায় বেশ একটা কৌতূহলী দিক আছে।
শিবের তেজে এল রমণীটির মুখ, অথচ সেই মুখে ভুরু ও কান ছিল না। বিষ্ণু দিলেন দশটা হাত, তাতে আঙুল জোড়া হল পরে। এ যেন কুমোরের প্রতিমা গড়া! অবশ্য, বিভিন্ন পুরাণে এর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা আছে। যাই হোক, হিমালয় থেকে একটা সিংহ নিয়ে (সিংহ অবশ্য পাহাড়ি পশু নয়) দেবী গেলেন দানব নিধনে। এই দেবীরই অন্য নাম চণ্ডী ও কাত্যায়নী। কোনও কোনও অঞ্চলে কাত্যায়নী নামটিই বেশি জনপ্রিয়, বাংলায় দুর্গা। কাজ শেষ হলে এই দেবী দেবতাদের বললেন, ‘আমি ফিরে আসব,’ তার পর শিবের পাদমূলে মিলিয়ে গেলেন। ফিরে আর আসেননি।
দেবী দুর্গার সেই রণরঙ্গিনী মূর্তি, তার সঙ্গে আর চার জন দেবতাকে জুড়ে দিয়ে যে পূজা, তা-ই বাঙালি হিন্দুদের কাছে কী করে প্রধান উৎসব হয়ে দাঁড়াল, তার উত্তর পাওয়া দুষ্কর। অনেকে মনে করেন, এটা ভাবপ্রবণ বাঙালির নিজস্ব সৃজনশীলতা! বাংলার কাব্য-গানে কিন্তু হিমালয় দুহিতা উমা বা পার্বতীরই প্রাধান্য। পতিনিন্দায় অপমানিতা সতী প্রাণত্যাগ করে হিমালয়ের কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করে শিবকেই আবার স্বামী হিসেবে পাবার জন্য দুস্তর তপস্যা করেন (নির্জলা উপবাস, কোনও গাছের পাতাও খেতেন না, তাই তাঁর আর এক নাম অপর্ণা)।
আমাদের আগমনী গানে থাকে, ‘যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী, উমা কত মা মা বলে কেঁদেছে’। এ যেন বাংলারই মেয়ে। কিন্তু, উমা বা পার্বতীর মূর্তি গড়িয়ে পূজা করা হয় না। যুদ্ধবিদ্যায় বাঙালি হিন্দুর তেমন খ্যাতি নেই, তবু তাঁরা দুর্গা এবং কালীর সংহার মূর্তির বেশি ভক্ত।
বিস্ময় আরও আছে, অত বড় দেবতা গণেশ যার বাহন সামান্য একটা ইঁদুর! যেমন, অমন রূপসী লক্ষ্মীদেবীর বাহন একটা প্যাঁচা! এতে যেন ঔচিত্যবোধের খুবই অভাব। এই সব বাহনের রূপকার্থ নিয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা তো হতেই পারে। আছেও। লক্ষ্মীমূর্তির বিবর্তনের ইতিহাসে দেখা যায়, নানা সময়ে তার বাহন ছিল ময়ূর, কূর্ম, সিংহ এবং হাঁস। কোনওটাকেই তিনি ধরে রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত জুটেছে প্যাঁচা!
এই প্যাঁচা সম্পর্কে পণ্ডিতদের একটি মত আছে। বিষ্ণুর বাহন গরুড়, আর বিষ্ণুপ্রিয়ার বাহন সেই গরুড়েরই ক্ষুদ্র সংস্করণ প্যাঁচা। প্যাঁচার মুখের সঙ্গে গরুড়ের খানিকটা মিল আছে, ঠিকই। তা হলে, গণেশ বাহন ইঁদুরও হতে পারে হাতির অতি ক্ষুদ্র বংশধর। সেই যে গল্পে আছে, হবুচন্দ্র রাজা জীবনে কোনও দিন শুয়োর দেখেননি, প্রথম ওই প্রাণীটি দেখে তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, মন্ত্রী, ওটা কী?
মন্ত্রীদের সবজান্তা হতেই হয়। তিনিও আগে কখনও শূকর দর্শন করেননি, তবু চটপট উত্তর দিলেন, মহারাজ, খুব সম্ভবত ওটা একটা হাতি, শুঁড়টুড় ক্ষইয়ে ফেলে ছোট হয়ে গেছে, কিংবা একটা ইঁদুর অনেক বড় হয়ে উঠেছে (গজক্ষয় অথবা মূষিক বৃদ্ধি)!
হিন্দু দেবদেবীদের বিবর্তনের ইতিহাস, একের সঙ্গে অন্যদের মিশে যাওয়া ইতিহাস, যা খুবই আকর্ষণীয়। প্রশ্ন হলো, বিবর্তিত হতে হতে দেবদেবী কী তাহলে দুনিয়া থেকে উঠে যাবে? ভলতেয়ার বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত দিন দারিদ্র্য থাকবে, তত দিন ধর্মকে একেবারে মুছে ফেলা যাবে না।
দরিদ্র, অত্যাচারিত, অসহায় মানুষ যখন মনে করে তাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই, কেউ তার পাশে দাঁড়াবে না, তখন সে মনে করে, আর কেউ না থাকুক, ঈশ্বর আছেন। সে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরে শান্তি পায়। আর, দরিদ্র মানুষদের এই দুর্বলতা দেখে দেশের উচ্চ স্তরের মানুষ, যারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের ধার ধারে না, যারা ক্ষমতালোভী, তারা ধর্মের নানা রকম বিকৃতি ঘটিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধায়। কথাটা আমাদের মতন দেশে এখনও অনেকটা সত্য।
শেষ কথা হলো, দুর্গাসহ তাঁর সহযোগী দেবদেবীর কাহিনি অত্যন্ত বৌচিত্রময় এবং রহস্যে ঘেড়া। বিভিন্ন দেবদেবীর সৃষ্টিতত্ত্ব মহাবিশ্বের মত; এ-ও যেন এক অনন্ত রহস্য!
এবারে বলি কলা বৌ বা নব পত্রিকা আসলে কি?
নবপত্রিকাঃ
দুর্গাপুজোতে যে নবপত্রিকা অর্থাৎ গণেশের পাশে দাঁড় করানো থাকে, যাকে আমরা কলা বউ বলে থাকি। সেটি আসলে নবপত্রিকা। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ বোঝায় নয়টি পাতা। কিন্তু এখানে নয়টি উদ্ভিদ দিয়ে নবপত্রিকা গঠন করা হয়। এই নয়টি উদ্ভিদ মা দুর্গার নয়টি শক্তির প্রতীক। এই নয়টি উদ্ভিদ হল কদলী বা রম্ভা (কলাগাছ), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মান ও ধান। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে সাদা অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদূর দিয়ে সিদ্ধিদাতা গণেশের ডানপাশে রাখা হয়। ৯টি উদ্ভিদে যে নয় দেবী অধিষ্টান করেন তা নিম্নরূপ ---
১। কলাগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী।
২। কচুগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা।
৩। হরিদ্রাগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা।
৪। জয়ন্তীগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী।
৫। বিল্বগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা।
৬। দাড়িম্বগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা।
৭। অশোকগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা।
৮। মানগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা।
৯। ধানগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
চামুণ্ডা।
৯। ধানগাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
সপ্তমীর সকালে পুরোহিত নিজে নবপত্রিকাকে নিয়ে কোনও নদী বা পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যান। সহ যাত্রীরা উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে মা দুর্গার ডানদিকে একটি কাঠের সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজা মণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়।
নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকেন।