বৃষ্টি ভেজা দিনে
ছুটি ছাটার দিন হলে গৌরবকে আর দেখে কে? সেদিন যে থাকে না সাত তাড়াতাড়ি নাকে মুখে গুঁজে নটার বাস ধরার তাড়া। তাই সপ্তাহের বাকী দিনগুলোর থেকে এই একটা দিন সে আরাম করে কাটাতে বেশি ভালোবাসে। দক্ষিণ দিকের জানলা দিয়ে আসা ক্ষীণ আলোর ছটা যখন তার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে, তখন গৌরব চোখ খুলে দেখে। বাইরেটা কেমন অন্ধকার। আবার সে পাশ ফিরে শোয়।এপাশ ওপাশ করার পর ঘুম আর আসবে না।বেলা যে বেশ হলো।তা দেখে বোঝা দায়। আসলে আকাশের মুখ যে ভার। তাই বেলা ঠাহর করা একটু কঠিনই বটে। বিছানায় বসে পাশের টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে ঘড়ির কাঁটা কখন এগারোটা পার করে গেছে। এরপর বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। গায়ে ঠাণ্ডা বাতাস এসে আছড়ে পড়ছে। চারদিকে কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।তখনো বৃষ্টি নামে নি। তবে জোলো ঐ ঠাণ্ডা বাতাস জানান দিচ্ছে বৃষ্টি হয়তো অন্য কোথাও শুরু হয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে মনটা কেমন আনন্দে দুলে উঠলো। নিজের অজান্তেই মনময়ূরী পেখম তুলে নাচতে শুরু করে দিল। এরকম মেঘলা আবহাওয়া বড় একটা পাওয়া হয় না তার। আর এরকম বৃষ্টি মুখর মেঘলা দিনে কার না মন ভালো হয়ে যায়। তা আবার যদি সেটা ছুটির দিন হয়। তাহলে তো আর কথাই নেই। ইতিমধ্যে মা বেশ কয়েকবার এসে ছেলের ঘরের কাছ থেকে ঘুরে গেছে। ছেলে শান্তিতে একটু ঘুমোচ্ছে।ঘুমোক। তাই না ডেকেই নিচে চলে যায়।
গৌরব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের চারপাশ টা ভালো করে লক্ষ্য করতে থাকে।এমন সময় মা এসে ডাকলেন,গৌর উঠছিস বাবা? গৌরব পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে মা। হাতে গরম চায়ের কাপ প্লেট।
--তুমি কি করে জানলে আমি উঠে পড়েছি?
তোর বারান্দার দরজা খোলার শব্দ পেয়েই বুঝেছি। তুই উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিস।
মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ প্লেটা সাবধানে নিজের হাতে নিয়ে নেয় গৌরব।আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। আহ!
তা নিয়ে সে আবার বারান্দার গ্রিল টার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সারা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।রোজ সকালের সেই সোনা মাখা রোদ্দুর আজ আর নেই।সূয্যিমামা ঘনকালো ঐ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।সবে দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চা টা শেষ করে ঘরের চটিটা গলিয়ে সে ছাতের দিকে পা বাড়ায়। মা বিছানা গুছিয়ে নীচে নেমে গেছে।ছাতের দরজার হ্যাজবোল্ডটা এক ঝটকায় খুলে ফেলল।ঢকাং করে একটা শব্দ হলো বটে। যদিও দরজাটা খোলা বন্ধ সব সময় ই এরকম একটা বিটকেল আওয়াজ হয় ই । আলতো করে দরজাটা ঠেলে দিতেই এক মুঠো ঠাণ্ডা বাতাস এসে গৌরকে জড়িয়ে ধরে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা মুহূর্তে কাজ করে গেল তার দেহ ও মনে।
এই ছাতটা যে তার বড়ো প্রিয় জায়গা। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই।ছাতেই মায়ের ঠাকুর ঘর। আর তার লাগোয়া একটা ঘর করা আছে। সেই ছোট্ট থেকে এটা ওর আস্তানা।ওর যাবতীয় খেলার সরঞ্জাম এখানে রাখা থাকতো। এখনো খুঁজলে কিছু জিনিস পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিছু না হোক গোটা কয়েক ঘুড়ি পাওয়া যেতেই পারে। ঘুড়ি ওড়াতে যে সে খুব ভালো বাসতো সে।
এতক্ষণে বৃষ্টিটা যে বেশ জোরে পড়তে শুরু করে দিয়েছে। না আর ছাতে দাঁড়ানো গেল না। তড়িঘড়ি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল।এই ঘরটায় বেশ অনেক গুলো জানলা। তাই খোলামেলা একটু বেশি। ঘরের পিছনের জানলাটা ওর খুব প্রিয়। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে অসুবিধা হয়না। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই বৃষ্টি এলেই এক দৌড়ে ছাতের এই জানলা টার পাশে গিয়ে দাঁড়াতো সে।এখান থেকে দেখা যেত কোয়েল দের বাড়ি , আর তার ঠিক পিছনে একটা ছোট পুকুর আছে। এখন যদিও সেটা ডোবা হয়ে গেছে।ঐ ডোবাটার চারদিকে প্রচুর গাছপালা ছিল। এখনো আছে। তবে আগের চেয়ে কম।ছাতের উপর থেকে দেখলে মনে হয় একটা বড় সবুজ রঙের গর্ত। আসলে বৃষ্টির জল পড়লে ডোবার জলটাও কেমন সবুজ হয়ে যায়।
সময় বদলেছে । ছোট গৌর আজ বড়ো হয়েছে। বাড়ির চারপাশের পরিবেশটা অনেকটা আগের মতো একই রকম আছে। বাইরে দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল নুইয়ে পড়া একটা পেয়ারা গাছের ডালে বসে রয়েছে একটা মাছরাঙা। রঙটাই যে তার প্রকাশ।তার নজর ঐ ডোবার জলের দিকে। আর কাঁঠাল গাছটায় বসে এক জোড়া কাক মনের সুখে ভিজছে। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে গৌররের মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়।
এরকম বৃষ্টি ভেজা দিনে তার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়।তার মঙ্গলার কথা মনে পড়ে যায়। মঙ্গলা যে তার ছোট বেলার খেলার সাথী। সে যে বৃষ্টির জলের মতো স্বচ্ছ প্রাণোচ্ছল।তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করতো, পড়াশোনা করতে যেত, স্কুল ও যেত। যদিও দুজনের স্কুল আলাদা ছিল।তারা একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ী ফিরতো। বৃষ্টির দিনে কাউকে না জানিয়ে চাটুজ্যেদের স্নান বাঁধানো পুকুরে ডুব ও দিত। প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে চারদিক যখন জল থৈ থৈ করত তখন সেই জমা জল ঘাটার জন্য নানা অছিলায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো। মা খুব বকাবকি করতো তখন। একান্ত বেরোতে না দিলে তারা ঘরের সামনের জমা জলে খবরের কাগজ দিয়ে বানানো নৌকা ভাসাতো ।।মা তাতে ও বকতো। বলতো, ওরে নামিস না নোংরা জল। কে শোনে কার কথা। ওরা দুজনে মিলে মায়ের একটা ভাঙা ঝুড়ি নিয়ে মাছ ধরে কাঁচের বোতলে ভরে রাখতো।কত পুরোনো কথাই তার মনে পড়ে যায়। একবার তো বোতল মঙ্গলার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। সব ধরে রাখা মাছ জলের মধ্যে হারিয়ে যায়। সে জন্য মঙ্গলবার সে কি কান্না।ওর ও খুব দুঃখ হয়েছিল। নিজের ধরা মাছগুলো ওকে দিতেও গিয়ে ছিলো। মঙ্গলা তা নেযনি।
আর একটা ঘটনা মনে পড়তেই গৌরবের হাসি পেয়ে যায়। একবার মঙ্গলার ছাড়া নৌকো একটু যেতে না যেতেই যখন উল্টে গেল তখন হাত পা ছড়িয়ে তার সে কি কান্না।ওর মা আমার মা কেউ তার কান্না থামাতে পারেনা।তখন আমার বাবা এসে ওকে একটা বড়ো নৌকো বানিয়ে দেয়। তারপর সেটা জলে ছাড়তে ওর কান্না থামে।
এরপর দুজনে একসাথে বড় হয়। স্কুল ছেড়ে দুজনে কলেজে ভর্তি হয়। তখনো বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে নি।মঙ্গলারা এখন আর এপাড়ায় থাকে না। একটু ভেতরে মালী পাড়ায় বাড়ি করে চলে যায়। তাতেও বন্ধুত্ব অটুট থাকে। দুজনে একসাথে সাইকেলে চড়ে টিউশন পড়তে যেত। সময় পেলে গঙ্গার পাড়ে গিয়েও বসতো। গঙ্গার পাড়ের ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিজেদের ভিজিয়ে নিতে দারুন লাগতো তাদের। বাড়ি ফেরার সময় পথে বৃষ্টি নামলে তারা একটা ছাতায় কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতো। গৌরব ইচ্ছা করে কখনো ছাতা নিয়ে বের হতো না। একটা ছাতায় দুজনে দুদিক থেকে ভিজে যেত। তবু ও তারা কোথাও দাঁড়াবে না।একে অপরের ভেজা স্পর্শ সাক্ষী হিসেবে থেকে যেত বৃষ্টি ভেজা পথঘাট, গাছপালা, নদী নালা সব কিছুই। আর আধভেজা অবস্থায় গৌরব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত মঙ্গলার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল কণার দিকে। দুটো ভেজা মন জন্ম দিত কিছু লাগাম ছাড়া ভেজা ভাবনার।
এখনো বৃষ্টি পড়লে গৌরবের মঙ্গলার কথা খুব মনে পড়ে। জানিনা মঙ্গলার কি তা হয়? একবার ও কি তার কথা মনে পড়ে না তার।
মঙ্গলা সেদিন খুব কেঁদে ছিল। যেদিন মঙ্গলা শ্বশুর বাড়ি চলে যায়।ওর কান্না দেখে গৌরব ও আড়ালে গিয়ে নিজের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারে নি। মঙ্গলা তো বিয়ে করতে চায় নি। শুধু মাত্র ওর জন্যই তো ওকে বিয়ে করতে হয়েছে। সেসময় গৌরব যদি একবার ওর পাশে দাঁড়াতো তাহলে দুজনের জীবন হয়তো অন্য রকম হতো। গৌরব তার মনের কথাটা যদি একবার মঙ্গলা কে বলতে পারত। পড়াশোনা,কেরিয়ার এসব নানা ভাবনা চিন্তায় তখন মঙ্গলাকে আর বলাই হয়ে ওঠেনি, মঙ্গলা আমি তোকে খুব ভালো বাসি রে। অনেক বার চেষ্টা করেও গৌরব মঙ্গলা কে তার মনের ভেতর জমে থাকা কথা গুলো বলে উঠতে পারে নি। এখনো পর্যন্ত সে সব না বলা কথা গুলো নিজের মধ্যে দলা পাকিয়ে রয়েছে।এখন যে খুব আফসোস হয় তার। হঠাৎ ই একরাশ বৃষ্টির ছাঁট এসে কাঁচের জানালায় আছড়ে পড়ে।সব আবার কেমন যেন আবছা হয়ে যায়।