Logo
logo

গল্প / কাহিনী

জীবনের জলছবি

"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ।।"

প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এখন দৈবাৎ দেখা যায়। ভাদ্র, আশ্বিন কিংবা আষাঢ়, শ্রাবণ এখন বর্ষাকাল বলে ধরা যায় না। কারণ এখন বর্ষা হয় নিম্নচাপে। যাইহোক, বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ, তাই বৃষ্টি আমাদের জীবনে অতি প্রয়োজনীয় সম্পদ। বৃষ্টি না হলে নদীনালা শুকিয়ে যায়, গাছপালা ও কৃষিতেও বিশাল ক্ষতি হয়। মানুষের বাঁচার জন্য চাই খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। বাংলা,বিহার, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব এই সমস্ত জায়গায় ধান, গম, তিসি, বাজরা এছাড়া নানারকম সবজি উৎপন্ন হয়। কোটি কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে তাই চাষীভাইরা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, কঠোর পরিশ্রম করে শস্য উৎপন্ন করেন।নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও আছে এই চাষের মধ্যে, যেমন পান, ফুল, পাট। চাষীভাইরাও ফুল চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে, আবার আমাদের পূজা-পার্বণের নানা অনুষ্ঠানে ফুল সরবরাহ করেন। গরীব চাষীরা চাষের জমিতে বীজ রোপণ করে ভালো ফসলের আশায়। তারা মহাজন এর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয় কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায়। কিন্তু বৃষ্টি না হলে বা অতিবৃষ্টি হলে চাষীদের খুব বড় ক্ষতির মুখে পরতে হয়। বৃষ্টি যেমন এক শ্রেণীর মানুষের কাছে আনন্দ বহন করে আনে, আবার অসহায় গরীব মানুষ, যাদের কোন স্থায়ী বাসস্থান নেই, যারা ফুটপাতে বা ঝুপড়িতে থাকে, তাদের কাছে এই বর্ষা ভীষণ কষ্টের। গ্রামের মানুষও বর্ষাকালে অনেক অসুবিধায় পরে। কারণ গ্রামের কাঁচা রাস্তা আর মাটির বাড়ি জল - বৃষ্টিতে বিপর্যয় এনে দেয়।এছাড়া বর্ষাকালে গ্রামেগঞ্জে সাপের উপদ্রব হয়, তাই বর্ষাকাল অনেক মানুষের জীবনে দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, সংরক্ষণের অভাবে ফুল-ফল-সবজি সব জলে ভিজে পচে যায়। বিদ্যুৎসহ ঝড়, যার ফলে প্রতিবছর অনেক চাষীর বজ্রপাতে মৃত্যু হয়, বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ে। ফলে ঘরবাড়ি ভেঙে যায়, মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাই বর্ষাকাল এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সুখের হলেও অনেক গরীব মানুষের কাছে বিভীষিকা ছাড়া আর কিছু নয়। ধনী ব্যক্তিরা উপভোগ করে ভালো খাবার আড্ডা গল্প আর গানের মাধ্যমে। আর অসহায় গরীব মানুষরা মাথা বাঁচানোর মিথ্যা লড়াই করে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে। আদিকাল থেকে ধনী দরিদ্রের এই অসম লড়াই চলে আসছে।

এক শ্রেণীর মানুষ বর্ষার রূপালী ফসল ইলিশ উৎসব পালন করার জন্য গঙ্গাবক্ষে ভেসে বেড়ায়, ইলিশের নানারকম পদ খেতে খেতে বর্ষাকে আরও আনন্দমুখর করে তোলে পয়সার বিনিময়ে। আর মৎস্যজীবিরা ইলিশ মাছ ধরার জন্য উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি দেয় জীবনকে বাজি রেখে কিছু অর্থ উপার্জনের আশায়। ঘরে তার বধূ কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মা পথ চেয়ে থাকে ছেলের ঘরে ফেরার আশায়। দেবতার থানে মানত রাখে। চাষীর পরিশ্রমের ফসল ধান, চাল, গম, ডাল, সবজি। ধনী সম্প্রদায়ের মানুষেরা সেরা দামের ফসল কিনে নেয় অধিক মূল্যের বিনিময় আর চাষীর কপালে জোটে মোটা চালের ভাত।

আমি রুমি। কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। তাই বৃষ্টিতে সেরকম কোন অসুবিধা হয়নি কখনও। জল থৈথৈ রাস্তাঘাটে স্কুলের ছুটির মজাই ছিল আনন্দের। আর বন্ধুরা মিলে বৃষ্টিতে ভেজা, গানশোনা, আড্ডা-গল্পে দিন কাটছিল ভালোই। বৃষ্টি মানেই খিচুড়ি আর নানারকম ভাজাভুজি ।এভাবেই আনন্দে ভাসতে ভাসতে জীবন কখন যে আমাকে বড় করে তুলেছিল, তা বুঝতে পারিনি। যখন বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করল, তখন বুঝলাম আমি বড় হয়ে গেছি।

অল্পদিনের মধ্যেই আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল গ্রামের এক চাষী পরিবারে, সেই সময় আমার প্রতিবাদ করার যোগ্যতা ছিল না। শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। গ্রামের কাঁচা রাস্তাঘাট, গাছ-গাছালি, পুকুর সবকিছুই ছিল আমার জীবনে বড্ড বেমানান। ইলেকট্রিক ছিলনা, ফলে সন্ধ্যা হলে পুরো গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে যেত। গ্রামের মানুষের দুর্গতির শেষ ছিল না। খুব সকালে সবাই মাঠে যেত চাষের জন্য আর আলপথে বিষাক্ত সাপের ছোবলে মৃত্যু হতো কত মানুষের। এছাড়া চাষের জমিতে কাজ করার সময় হঠাৎ বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত শুরু হলে বজ্রপাতের মৃত্যু হতো কত মানুষের। আমার দু'চোখ ভরা স্বপ্নগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগলো। ভালোবাসার মানুষদের থেকে অনেক দূরে এক গণ্ডগ্রামে অসহায় হতে থাকলাম আমি। একদিন ভরা বর্ষণে আমি দেখতে পেলাম আমার জানলার পাশে আমগাছটায় অনেক পাখির বাসা। সেখানে কাঠবিড়ালিরা খেলে বেড়ায় মহানন্দে। আমি গাছটাকে ভালবাসতে শুরু করে দিই। আমার জীবনে এ এক নতুন সঙ্গী। সন্ধ্যাবেলায় যখন সারা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে যায়, তখন আমি দেখি হাজার নক্ষত্রমালায় সেজে উঠেছে আমার বন্ধু। খুব সুন্দর লাগে আমার মন ভালো হয়ে যায়। সুখ দুঃখের কথা বলার এই নতুন সঙ্গীকে আমি জানাই আমার মনের কথা। গাছটা তার ডালপালা নেড়ে আমাকে সঙ্গ দেয়।

হঠাৎ এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়, আমি জানলার কাছে গিয়ে দেখি আমার সখা অসহায়ের মতো ঝড়ের তান্ডব থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করি, আম গাছটা তার ডালপালা নেড়ে আমাকে যেন কিছু বলতে চাইছিল। ঝড়ের প্রলয় নৃত্যের কাছে অবশেষে হার মানে আমার একমাত্র বন্ধু। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে মাটিতে, প্রবল বৃষ্টিতে আমি তার কাছে যেতে পারে না। সকাল বেলা রাস্তার কাছে যাই।দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে আমার। পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিই গাছটার গায়ে। কেউ জানতে পারে না আমার এই গোপন বন্ধুত্বের কথা। কাঠুরিয়া এসে গাছটাকে কাটতে শুরু করলে আমার বুকে বিদায়ের বেদনা মোচর দেয়। আমার মনে হয় লাশ কাটা ঘরে চলে যাবে স্বজনসখা। আমি আস্তে আস্তে বাগানে যাই। একটা ছোট্ট আম গাছের চারা বসিয়ে দিই সখার বেদিতলে। প্রতিদিন জল দিই গাছটায়, সেবা-যত্নে বেড়ে ওঠে নতুন উত্তরসূরী। বর্ষা যেমন অনেক প্রাণ কেড়ে নেয়, তেমনি নতুন প্রাণের সঞ্চার করে তার পবিত্র বারিধারায়। জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াইটা শুরু হয় এভাবেই গ্রাম্য জীবনে।

আমি বুঝতে পারি এভাবে থেমে গেলে চলবে না। গ্রামের সহজ-সরল খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে হবে। প্রতি বর্ষায় সর্পদংশনে বা বজ্রপাতে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না, তাই আমি পরিবারের অনুমতি নিয়ে স্বজনহারা প্রতিবেশীদের সাহায্যের জন্য কাজ করতে শুরু করি। আমার এই উদ্যোগে অনেক গ্রাম্য মহিলাকে পাশে পেয়ে যাই। প্রতি বর্ষায় সাপের কামড় থেকে আত্মরক্ষার উপায় এবং ওঝার কাছে না গিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া শুরু হয়। বৃষ্টির পূর্বাভাসের খবর পেলে যাতে চাষীভাইরা সতর্কভাবে কাজ করে এবং বজ্রপাতের সময় ঠিকমতো জায়গায় আশ্রয় নেয়, অধিক ফসল বর্ষার জলে যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য সরকারের সাহায্য এবং বিডিও অফিসে গিয়ে ফসল সংরক্ষণ এবং বন্টন ব্যবস্থার ঠিকঠাক সুরাহা করা ও তার উপায়, বন্যার জলে যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে যায় তাদের জন্য সরকারি সাহায্য বা ত্রাণের ব্যবস্থা করা, এতে গ্রামের অসহায় মানুষগুলো কিছুটা হলেও বাঁচার আনন্দ পায়। শিশু ও মহিলাদের পরিবারকে সাহায্য করার পরামর্শ দিতে শুরু করি আমি। এভাবে গ্রামের এক সামান্য গৃহবধূ থেকে আমি হয়ে উঠি সকলের নয়নের মণি। গ্রাম বাংলার বর্ষামঙ্গলের এ এক রঙিন প্রচ্ছদ।

"আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী'পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।।"

Contact US

Tel: 9903329047 / 8697419047
Email: sreemotirdarbar@gmail.com